
ফরমান শেখ, ভূঞাপুর ॥
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এ হাসপাতালটিতে ভূঞাপুর ছাড়াও পাশ^বর্তী গোপালপুর, ঘাটাইল ও কালিহাতী উপজেলার লোকজন চিকিৎসা নিতে আসে। জনগুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালটি এখন নিজেই এক অসুস্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলা হাসপাতালের ভেতর-বাহিরে নানা অব্যবস্থাপনা, জনবল ও যন্ত্রপাতির সংকট। সব মিলিয়ে এই সরকারি হাসপাতাল এখন রোগীদের ভোগান্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এদিকে, এই হাসপাতালের পরিবেশ নিয়েও রয়েছে গুরুত্বর অভিযোগ। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে দেখা যায় নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ময়লা-আবর্জনা ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। দুর্গন্ধময় পরিবেশে রোগী ও স্বজনদের থাকতে হয় দীর্ঘ সময়। বিশেষ করে টয়লেটের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। অধিকাংশ টয়লেটের ভেতরে সমস্যা, পরিচ্ছন্নতার কোনো বালাই নেই। পুরুষ ও নারী উভয় ওয়ার্ডের রোগীরা একই অভিযোগ করছেন।
এছাড়াও ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালে একটি জেনারেটর থাকলেও তা চালু করা হয় না। সেটিও অনেক পুরনো। বিদ্যুৎ চলে গেলে পুরো হাসপাতাল অন্ধকারে ডুবে যায়। চার্জিং বাল্বের ব্যবস্থা থাকলেও তা কয়েকটি বাতিতে সীমাবদ্ধ। বাকি অংশ অন্ধকারে থাকে, যা বিশেষ করে রাতে রোগী ও স্বজনদের জন্য ভীতিকর হয়ে ওঠে। সরেজমিনে সন্ধ্যার পর উপজেলার একমাত্র সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডে থাকা চার্জিং বাতি থাকলেও লোডশেডিং চলাকালীন তা নামমাত্র। কিছুক্ষণ জ্বলার পর সেটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডে (ডায়রিয়া) আবার সেটাও নেই। যেন এক ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। পর্যাপ্ত আলো না থাকায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে এ সময় নার্সদেরকে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে দেখা গেছে।
অপরদিকে, প্রচন্ড গরমে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে শিশু ও বয়স্ক রোগীরা। এই ওয়ার্ডে আটটি ফ্যানের মধ্যে তিনটিই নষ্ট। যে কয়টি ভালো আছে লোডশেডিংয়ে ফ্যান বন্ধ থাকায় ওয়ার্ডে ভ্যাপসা গরমে শিশুরা হাঁসফাঁস করছে, স্বজনরা হাতপাখা বা চার্জার ফ্যান এনে সামান্য স্বস্তির চেষ্টা করছেন। দো-তালায় উঠার সিঁড়িতে বেশ ময়লা, মেঝেতে ময়লার দাগ, দেয়ালের কোথাও কোথাও কফ, থুতু ও পানের পিকের দাগ। রোগীদের শয্যা, ওষুধ রাখার ট্রেতে মরিচা, ময়লার দাগ। এর মধ্যে মাছি উড়ছে, যা হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা আরও প্রকট করে তুলেছে।
হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢুকতেই দেখা যায় বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন কয়ড়া গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী। যেখানে নেই কোনো ফ্যানের ব্যবস্থাও। আকবর আলী জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেওয়ার পরও কেভিন বা বিশেষ সুবিধা কিছুই দেওয়া হয়নি তাকে। আরও জানান, এখানে টয়লেটে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই।
হাসপাতালে কর্তব্যরত নার্সরা জানান, হাসপাতালের জেনারেটর রয়েছে, কিন্তু তা চালানো হয় না। বিদ্যুৎ চলে গেলে আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাদের ভাষায়, বিদ্যুৎ না থাকায় ওয়ার্ডে কাজ করতে গিয়ে চোখে দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী জানান, জেনারেটর থাকলেও সেটি চালানো হয় না।
তিন মাসের শিশু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোজিনা বেগম নামে এক নারী বলেন, দুইদিন ধরে আমি হাসপাতালে আসার পর খাবার ও পানির পরিমাণ কম খাচ্ছি, যাতে টয়লেটে না যেতে হয়। টয়লেটে গিয়ে আমি এখন নিজেই অসুস্থ হওয়ার উপক্রম। টয়লেটে যাওয়ার উপায় নেই। দুর্গন্ধ আর নোংরায় পরিবেশে ভেতরে প্রবেশ করাই যায় না।
গোপালপুর উপজেলার বড়শিলা থেকে আসা রোগীর দাদী সাজেদা বেগম বলেন, এই হাসপাতাল অসুস্থ মানুষ চিকিৎসা নিতে এসে তার স্বজনরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এসব বিষয়ে অভিযোগ করার জায়গা নেই।
স্থানীয়রা বলছেন, ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখন কার্যত একটি অসুস্থ প্রতিষ্ঠান। যথাযথ নজরদারি ও ব্যবস্থাপনার অভাবে সরকারি এই হাসপাতালটি দিনে দিনে রোগীদের জন্য অনিরাপদ ও অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। তাদের দাবি, বিগত ২০২২ সালে ডা. মোহাম্মদ আব্দুস সোবহান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচও) হিসেবে যোগদানের পর থেকেই এই হাসপাতালের এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ডা. সোবহান প্রশাসনিক দিক থেকে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব পোষণ করেন। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাবর গতবছর অভিযোগ দায়ের করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারা আশঙ্কা করেন, কেউ মুখ খুললেই তাকে বদলি বা হয়রানির মুখোমুখি হতে হবে।
ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. খাদেমুল ইসলাম বলেন, সমস্যা যে নেই সেটি বলছি না। তাছাড়া আমরা কেউই শতভাগ কাজ করতে পারি না, আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আব্দুস সোবাহান বলেন, জেনারেটর থাকলেও এটার জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মাঝেমধ্যে আমরা জেনারেটর চালু করি। আমাদের ক্লিনারের সংখ্যা একজন। বাইরে থেকে লোক ডেকে এনে ঠিক করতে হয়। আর ফ্যান-লাইট যেকোনো সময় নষ্ট হতে পারে। যখন আমার নজরে আসে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বারান্দায় চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেভিনের ব্যবস্থা আছে। বারান্দায় থাকার কথা নয়। এটি হয়ে থাকলে তদন্ত করব।