
স্টাফ রিপোর্টার ॥
টাঙ্গাইলের গজারি বনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থামছেই না। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এ প্রাকৃতিক বনে একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে বনজ সম্পদ ভস্মীভূত হয়। প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হয় না। দোষীরাও গ্রেফতার হয় না। ফলে বন অপরাধ ও বনভূমি জবরদখল বন্ধ হয় না। অবশ্য বন বিভাগ বলছে, তারা বনে অগ্নিকাণ্ড বন্ধে টহল জোরদার করছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নগণ্য।
জানা যায়, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় বনভূমির পরিমান ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৩৬ একর। এর মধ্যে জবর দখল প্রায় ৬২ হাজার একর। বড় জোর ৩০ হাজার একরে প্রাকৃতিক শালবন টিকে রয়েছে। কিছু এলাকায় এখনো জীববৈচিত্র্য এবং বহুস্তর বিশিষ্ট বন বিদ্যমান। বনভূমির বড় একটি অংশে রয়েছে বিদেশি গাছের উডলট মডেলের সামাজিক বনায়ন। কিন্তু এসব সামাজিক বনায়নে কখনো আগুন ধরে না। এর আশপাশে থাকা গজারি বনেই শুধু আগুন লাগে।
এলাকাবাসিরা জানান, সামাজিক বনায়ন করার জন্য প্রচুর সরকারি টাকা বরাদ্দ থাকে। তাই গজারি বন সাবাড় করা গেলে প্লট বরাদ্দের মাধ্যমে সেই বিরান বনভূমিতে সামাজিক বনায়ন করা যায়। এতে সব পক্ষেরই লাভ। এ কারণেই পরিকল্পিতভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয় বলে তাদের অভিমত।
টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হতেয়া, বহেড়াতৈল ও বাঁশতৈল রেঞ্জে অহরহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এতে সুফল প্রকল্পের দেশি জাতের বৃক্ষচারাসহ গজারি বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বহেড়াতৈল রেঞ্জ অফিসার এমরান আলী জানান, বদ অভ্যাস থেকে মানুষ বনে আগুন দেয়। থানায় একাধিক জিডি দায়ের হয়েছে। ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া রেঞ্জেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। রেঞ্জ অফিসার ওয়াদুদ জানান, এবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কম। তবে এখানকার জবরদখলকারিরা খুবই প্রভাবশালী। জবরদখল বন্ধ করতে গেলে একজন বিট অফিসারসহ ৯ বনকর্মী আহত হন। কিন্তু ঘাটাইল থানা পুলিশ আসামি গ্রেফতার না করায় বনভূমি পুনরুদ্ধার ও বন অপরাধ দমনে সমস্যা হচ্ছে।
গত (২৪ মার্চ) ময়মনসিংহ বন বিভাগের আওতায় ভালুকা উপজেলার উথুরা রেঞ্জের আঙ্গারগারা বিটের চানপুর এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে তিন একর বেতবাগান ও গজারিবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিট অফিসার মাজহারুল ইসলাম জানান, কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে আগুন লাগায়। গত (৩১ মার্চ) একই জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার সন্তোষপুর বিটে এক অগ্নিকাণ্ডে এক একর বেতবাগান এবং কিছু গজারিবন পুড়ে যায়। বনকর্মী এমদাদুল হক জানান, দর্শনার্থীদের কেউ হয় তো আগুন দেয়। গত (২০ মার্চ) থেকে (৮ এপ্রিল) পর্যন্ত মধুপুর বনাঞ্চলের মধুপুর, দোখলা ও জাতীয় সদর উদ্যান রেঞ্জে ১০/১২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জঙ্গল পুড়ে যায়।
দোখলা রেঞ্জ অফিসার সিরাজুল ইসলাম জানান, ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। অগ্নিকাণ্ড যাতে না হয়, এজন্য ১২ জন ফায়ার ওয়াচার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ‘পরিবেশ ও প্রতিবেশ’ সংস্থার গবেষণায় বলা হয়- আগুনে বনের গাছপালা, গুল্মলতাদি ও ভেষজ উদ্ভিদই শুধু পোড়ে না- বণ্যপ্রাণী, পশুপাখি ও মৌমাছির আবাসস্থল ধ্বংস হয়। মাটির নিচের বহু কীটপতঙ্গ সমূলে বিনাশ হয়। ইকোসিষ্টেম ধ্বংস হয়। এটিকে টাকার অঙ্কে বিবেচনা করা যাবে না।
পরিবেশকর্মী ড. আবু রায়হান জানান, শালবনে অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে ভূমি দস্যুরা। বনকর্মীদের সঙ্গে সমঝোতা করে সুযোগ বুঝে বিরান বনভূমি দখলে নিয়ে তারা কলা আর আনারসসহ অন্যান্য ফসল লাগান। এ দখলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সামাজিক বনায়নের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে থাকেন তারা।
মধুপুর বনাঞ্চলের দোখলা গ্রামের ফরমান আলী জানান, অগ্নিকাণ্ডে লেবাররা লাকড়ি পায়, চোরেরা গাছ পায়, ভূমি দস্যুরা জমি পায় ৷ এর মধ্যে আরো একটি দল আছে, তাদের কথা না বলাই ভালো। এ চার দুষ্টচক্র নেপথ্যে জড়িত।
মধুপুর বনাঞ্চলের সহকারী বন সংরক্ষক আশিকুর রহমান জানান, অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতি এবার খুব কম।