
স্টাফ রিপোর্টার ॥
আবারও টাঙ্গাইল মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র সন্তোষ ভাসানী আদর্শ কলেজে নিশ্চিত হয়েছে। ওইদিন কেন্দ্র বহাল থাকার বোর্ড ঘোষিত বিজ্ঞপ্তিটি অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত ফেসবুকে পোস্ট দেন। অন্য কোন কলেজ অধ্যক্ষ এমন পোস্ট না দেয়ায় মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের ওই পোস্ট নিয়ে বির্তকের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ নিশ্চিত হওয়াসহ আনন্দ উল্লাসের নানা কমেন্টস আর অধ্যক্ষকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনসহ মিষ্টিমুখ করানোর কমেন্টসকে ঘিরেও ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তিতে পোস্ট নিয়ে বির্তক আর পরীক্ষার্থীদের কমেন্টস এর বিষয়ে এই সংবাদের প্রতিবেদক জানতে চাওয়ায় পোস্টটি ডিলিট করেন অধ্যক্ষ। তবে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পরে অধ্যক্ষ স্বাক্ষরিত ও রঙিন কলমে চিহ্নিত করা বিজ্ঞপ্তির কপিটি ও শিক্ষার্থীদের কমেন্টস।
শহরের সুনামধন্য কলেজের অধ্যক্ষের বিতর্কিত ওই পোস্ট আর শিক্ষার্থীদের এমন কমেন্টস এর উম্মাদনা নিয়ে বিশিষ্টজন আর শিক্ষানুরাগীদের মাঝে বইছে ব্যাপক আলোচনা আর সমালোচনা ঝড়। কেন্দ্র নির্ভর ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা, এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। শিক্ষার্থীদের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিতে আর কলেজের শিক্ষার মান রক্ষায় মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র অন্যত্র নেয়ার দাবিও তুলেছেন অনেকে। এছাড়াও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এইচএসসির টেস্ট পরীক্ষায় অর্ধেকের বেশি পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কলেজ সংশ্লিষ্টরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে সরব হয়েছে উঠেছে মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে জিমামুল হক এর জুনিয়রদের ভয় নাই ভাসানী গার্ড নাই, খালি মধু মধু রসমালাই, সোহাগ আহমেদের আজকেই বই খাতা বিক্রি করে দিব, অভি আহমেদ এর জিপিএ-৫, ইয়াহিয়া তালুকদারের জিপিএ-৫ মোবারক, সূচনা তাহারিয়ার পরীক্ষার্থীরা স্যারকে মিষ্টি খাওয়াও, সামী শহিদুল ইসলামের আমার প্রিন্সিপাল স্যার বেস্ট অফ দ্যা বেস্ট, তাসনুভা সূচির যাক এইবার একটু শান্তি পেলাম, লামিয়া মুসকান এর স্যার মিষ্টি খেলে বলেন আগেই নিয়ে যাই এমন শত শত কমেন্টস কলেজের ফেসবুক পেইজে অধ্যক্ষের দেয়া কমেন্টসকে কেন্দ্র বহাল থাকার ওই বিজ্ঞপ্তির পোস্টে প্রকাশ পাচ্ছে।
এছাড়া গত এইচএসসি পরীক্ষায় সন্তোষ ভাসানী আদর্শ কলেজ কেন্দ্রে মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অসদুপায়ে পরীক্ষা দেয়ার ছবিও সংবাদের প্রতিবেদকসহ বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়েছে।
জানা যায়, বিগত ১৯৮৯ সালে (১৯ মে) প্রতিষ্ঠিত হয় মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়। বিগত ২০০৩ সালে বাংলাদেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মান পেয়েছিল মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়। জেলার সুনামধন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। পাশের হার প্রায় ৯৮%। ২০২৪ সালে এ কলেজ থেকে ১৩৮১ শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪১০ জন। আর ২০২৩ সালে ১৩৫১ শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পায় ১৯৭ জন। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষায়ও প্রায় ১৩২০ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে।
সরেজমিন দেখা গেছে, কলেজের শ্রেণী কক্ষে শিক্ষক উপস্থিতি থাকলেও এইচএসসি প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী উপস্থিতি যতসামান্য। কোন ক্লাসে দুই/তিন জন আবার কোন ক্লাসে শিক্ষার্থী উপস্থিতি একেবারের নেই বলে জানান দায়িত্বরত শ্রেণী শিক্ষকরা। তারা বলেন, শিক্ষার্থী উপস্থিতি না থাকলেও নিয়ম অনুযায়ি তাদের ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কেন জানি ক্লাস বিমূখ হয়ে পড়েছে। চেষ্টা করেও শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো যাচ্ছে না বলে জানান দায়িত্বরত শিক্ষকরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের একাধিক সূত্রের অভিযোগ, ২০২৫ সালের এইচএসসির টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এই কলেজের প্রায় ১৩২০ছাত্র/ছাত্রী। এর মধ্যে সব বিষয়ে পাশ করেছে মাত্র ৬০০ জন। আর একাধিক বিষয়ে ফেল করেছে প্রায় ৮০০জন। টেস্ট পরীক্ষার ফি ছিল ৫০০ টাকা। পরবর্তীতে ১০০০ টাকা ফি নিয়ে ৩০ নম্বরে নামমাত্র রিটেস্ট পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। যদিও রিটেস্ট পরীক্ষায় প্রতি পত্রের জন্য বোর্ড নির্ধারিত ফি-৪০ টাকা। ৮’শ রিটেস্ট পরীক্ষার্থীর কাছে থেকে বোর্ড নির্ধারিত ফি’র বিপরীতে নেয়া অতিরিক্ত টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
অপরদিকে সন্তোষ আদর্শ কলেজে দফায় দফায় এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে অসদুপায়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করাসহ ভালো ফলাফল দেখাচ্ছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। যার ফলে এতো জিপিএ-৫ পেয়েও পূর্বের মতো এই কলেজের শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাচ্ছে না বুয়েট, মেডিকেল বা ঢাকা, রাজশাহী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশ সেরা বিদ্যাপিঠগুলোতে। কলেজ কর্তৃপক্ষের এহেন হীন মানসিকতার কুফল ভোগ করছে অধ্যারনরত শিক্ষার্থীরা। আর মান হারাচ্ছে জেলার সর্বোচ্চ সুনামধন্য মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ জেলা প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের কাছে আসন্ন এইচএসসিসহ আগামী দিনের পরীক্ষাগুলোর কেন্দ্র সন্তোষ আদর্শ কলেজের পরিবর্তে অন্যত্র স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকরা।
গত এইচএসসি পরীক্ষায় সন্তোষ ভাসানী আদর্শ কলেজ কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা স্কুল শিক্ষক মতিন বলেন, কোন সুযোগ সুবিধা না পেলে শহরের কলেজ কেন গ্রামের এমন একটি কলেজ কেন্দ্র বেছে নেবে, এ প্রশ্নেই তো সব উত্তর রয়েছে। শহর থেকে যাতায়াতের চরম সমস্যা সত্ত্বেও মাহমুদুল হাসান কলেজের শিক্ষার্থীরাই বা কেন এই কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক, সেটি ভেবে দেখেন। রিটেস্ট পরীক্ষার বোর্ড নির্ধারিত ফি পত্র প্রতি ৪০ টাকা বলে নিশ্চিত করেছেন সরকারি শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা মহাবিদ্যালয়ের পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক শামছুল হক।
মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ইব্রাহিম বলেন, এইচএসসি টেস্ট পরীক্ষায় কলেজের প্রায় ৮’শতাধিক পরীক্ষার্থী একাধিক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছিল। পরবর্তিতে রিটেস্ট পরীক্ষা দিয়ে তারা উত্তীর্ণ হয়েছে। রিটেস্ট পরীক্ষার ফি ১ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে রিটেস্টর ফি নির্ধারণ করা হয়। তিনি আরও বলেন, আহ্বায়কের দায়িত্ব আমি পেয়েছি কিনা জানি না। তবে ইতোপূর্বে আমি এই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছি। কলেজের রেজাল্ট ভালো হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কলেজের শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ হারে কেন বুয়েট, মেডিকেল বা ঢাকা, রাজশাহী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশ সেরা বিদ্যাপিঠগুলোতে সুযোগ পাচ্ছে না। সে বিষয়ে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কতিপয় শিক্ষক বলেন, এই কলেজের কেন্দ্র এক সময় কুমুদিনী সরকারী কলেজে ছিল। সে সময় পাশ করা শিক্ষার্থীরা ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পেয়েছে। কলেজের তৎকালীন সময়ের অনেক শিক্ষার্থীই এখন ডাক্তার, সেনা কর্মকর্তা, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করছে। বেশ কয়েক বছর যাবৎ আগের থেকে ফলাফল ভালো হলেও শুনছিনা এই কলেজের শিক্ষার্থীরা ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পেয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। ফলাফলের বিবেচনা না করে, মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরির প্রতি কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম উজ্জল বলেন, এক কলেজে দফায় দফায় কেন্দ্র নির্ধারণে কোন বাধা নেই। এছাড়া আমাদের কলেজ নিয়েও কোন অভিযোগ নেই। শহর থেকে গ্রামের কলেজে দফায় দফায় কেন্দ্র নেয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কেন্দ্র বহাল থাকার পোস্ট দেয়া আর শিক্ষার্থীদের কমেন্টসের বিষয় নিয়ে করা প্রশ্ন এড়িয়ে যান এই অধ্যক্ষ।
মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ সভাপতি প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন. মাত্র ৬ মাস হলো আমি এই কলেজের সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছি। ইতোপূর্বে পরীক্ষা কিভাবে হয়েছে, কি সুযোগ নিয়েছে পরীক্ষার্থীরা কিছুই আমি জানিনা। এরপরও পরবর্তি পরিচালনা পর্ষদ সভায় অভিযোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
সন্তোষ আদর্শ কলেজ অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন বলেন, গত বছর থেকে আমার কলেজে মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের কেন্দ্র পড়ছে। এই কেন্দ্রে নকল চলে তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেছে তিনি।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুজিবুল আহসান বলেন, পরীক্ষা কেন্দ্র দেয়ার বিষয়টি জেলা প্রশাসন দেখেন। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই মন্ত্রণালয় কেন্দ্র নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) সঞ্জয় কুমার মহন্ত জানান, কেন্দ্র বা ভেন্যু নির্বাচন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের কোন মতামত নেয়া হয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে পরবর্তি ব্যবস্থা নেয়া হবে।