
হাবিবুর রহমান, মধুপুর ॥
টাঙ্গাইলের মধুপুর পাহাড়িয়া লাল মাটি লেবু চাষের খুবই উপযোগী। মাটির গুণাগুণ ভালো থাকায় কৃষি ফসল উৎপাদনে এ অঞ্চল বিক্ষাত। কৃষিই এ অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কৃষি নির্ভর চাষাবাদে ছোট বড় কৃষকরা দিন দিন বাণিজ্যিক চাষাবাদে এগিয়ে যাচ্ছে। আনারস কলা, পেঁপে, হলুদ, পেয়ারা, কচু, আদার পর লেবুও কৃষি ফসল চাষের তালিকায় অন্যতম স্থান দখল করেছে। এখন লেবুর মৌসুম না হলেও রমজান মাসে লেবুর চাহিদা বেশি। বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয়েছে মৌসুম। রমজানে লেবুর চাহিদা বেশি আর যোগান কম থাকার কারণে লেবুর বাজারে উত্তাপ ছিল বলে জানিয়েছে চাষি ও পাইকাররা। কৃষি বিভাগ বলছেন, মধুপুরের মাটি আবহাওয়া, ভূ-প্রকৃতি কৃষি ফসল চাষের জন্য উপযোগী। এ বছর লেবু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২১৫ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ২১৭ হেক্টর জমিতে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পাহাড়ী গড়ে সারাবছরই লেবু পাওয়া যায়। এক সময় দেশি কাগুজি লেবু চাষ হলে এখন উন্নতজাতের সীডলেস লেবু চাষ হচ্ছে। আকারে বড় বেশি রসালো সিডলেস লেবু চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি থেকে শুরু করে বড় চাষিরাও লেবু চাষে আগ্রহী হচ্ছে। ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিরা বিঘায় বিঘায় আর বড় চাষিরা একরে একরে চাষ করছেন। এভাবে গড় এলাকার অরণখোলা, বেরিবাইদ, আউশনারা, কুড়াগাছা, শোলাকুড়ি, ফুলবাগচালা ইউনিয়নে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে লেবু।
বনাঞ্চল ঘেরা লাল মাটির কয়েকটি ইউনিয়ন মিলে মধুপুর গড় যেন এক খণ্ড লেবুর রাজ্য হয়ে উঠেছে। স্থানীয়রা লেবুর চাষকে কেন্দ্র করে মধুপুর-মুক্তাগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী রসুলপুর ও রাজাবাড়িতে গড়ে উঠেছে পাইকারি লেবুর বাজার। সপ্তাহে দুইদিন রাজাবাড়ি আর বাকি ৫ দিন রসুলপুরে লেবুর বাজার বসে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠা বাজারে চারদিক থেকে কৃষক পাইকাররা লেবু নিয়ে আসে। দুপুর থেকে শুরু হয় বাজার। কৃষক, পাইকাররা ভ্যান-রিকশা, ঘোড়ার ঘোড়ার গাড়ি, অটোবাইকে নিয়ে আসে লেবু। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকার, আড়তদাররা আসেন এই বাজারে। রমজানে প্রতিবছরই লেবুর দাম বেশি থাকে। লেবু পরিপক্ক হওয়ার আগেই এ বছর রমজান শুরু হয়েছে। এ কারণে অমৌসুমে লেবুর দাম অনেকটাই বেশি ছিল। লাল মাটির লেবুর গুনগত মান ভালো থাকার কারণে চাহিদাও বেশি। দুপুর থেকে বিকালের মধ্যেই বেচাকেনা শেষ হয়ে যায়।
জৈষ্ঠ্যমাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত লেবুর মৌসুম চলে। বাকি কয়েক মাস লেবুর উৎপাদন কম হয়ে থাকে। তবে মৌসুমের চেয়ে অমৌসুমে দাম বেশি থাকে। কারণ এ সময় গাছে লেবু কমে আসে। আমদানি কম থাকার কারণে ভালো দাম পাওয়া যায়। তবে লেবু বারোমাসি ফসল হলেও মাঘ মাস থেকে বৈশাখ পর্যন্ত চড়া দামে বেচাকেনা হয়।
রসুলপুর বাজারে কথা হয় রাজা বাড়ি গ্রামের রফিকুল ইসলামের সঙ্গে, তিনি বাজারে দুই বস্তা সিডলেস লেবু নিয়ে এসেছে। দাম চড়া থাকায় দুই বস্তা লেবু বিক্রি করেছে ১৮ হাজার টাকা। ভ্যান ভাড়া ও খরচ বাদে তার আয় হয় ১৫ হাজার টাকা। রাজাবাড়ি গ্রামে শামছুল হক বাজারে লেবুর পাইকারি ব্যবসায়ী।
তিনি জানান, এখন লেবুর মৌসুম নয়, তাই দাম একটু বেশি। প্রতিটি লেবু ৭-৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি এ বাজার থেকে লেবু কিনে রাজধানী ঢাকাসহ বরিশাল সিলেটে লেবুর ব্যবসা করে থাকে। বাগানে গিয়ে দেখা হয় মিনহাজ আলীর সঙ্গে, তার বাবা ৮ বিঘা জমিতে সিডলেস জাতের লেবু চাষ করেছে। রমজানে লেবুর দাম আরো বাড়বে এমনটাই ধারণা তার। তিনি তিন বস্তা লেবুর দাম পেয়েছে ২৪ হাজার টাকা। বাজারে লেবু নিয়ে আসা ভ্যান চালক সাইফুল ইসলাম জানান, খেত থেকে এক ভ্যান লেবু তুলে বস্তা প্যাকেট করে বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ভাড়া পায় ৮০০ টাকা। তিনি প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লেবু তুলে বস্তায় প্যাকেট করে তার নিজস্ব ভ্যানে লেবু বাজারে নিয়ে আসা তার প্রতিদিনের কাজ।
মুক্তাগাছা উপজেলার পাহাড় পাবইজান গ্রামের কালু মিয়া জানান, তিনি সারা বছর লেবুর ব্যবসা করেন। রসুলপুর রাজাবাড়ি বাজার থেকে লেবু কিনে নেত্রকোণা মোহনগঞ্জসহ কয়েকটি মোকামে পাঠায়। সিজনের সময় এ বাজারে ১৫-২০টি ট্রাক লোড হয়। এখন অমৌসুমে ৪-৫টি ট্রাক লোড হয়। আমদানি কমের কারণে দাম বেশি। এখন গাছে ফুল ধরার সময় হচ্ছে। কয়েকদিন পর ফুল আসবে। জৈষ্ঠ্যমাস থেকে পুরো মৌসুম শুরু হবে। স্থানীয় লেবু ব্যবসায়ীরা জানান, রাজাবাড়ি, কাটাজানি, চানপুর, বালিয়াপাড়া, কাঠবওলা, গেচুয়া, বেরিবাইদ, মাগন্তিনগর, গায়ড়া টেলকি, জলই, তালতলা, খাজুরিয়া, কমলাপুর, কাকড়াগুণি, জালাবাঁধাসহ মধুপুর গড়ের বিভিন্ন গ্রামে কম বেশি লেবুর চাষ হয়ে থাকে। এ চাষকে কেন্দ্র করে দুটি বাজার গড়ে উঠেছে।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রকিব আল রানা জানান, মধুপুরের মাটি আবহাওয়া ভূ-প্রকৃতি কৃষি ফসল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। এ বছর লেবু চাষের জমির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২১৫ হেক্টর। চাষ হয়েছে ২১৭ হেক্টর জমিতে। এ এলাকার লেবুর গুণগত মান ভালো হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে যায়।