
স্টাফ রিপোর্টার ॥
তিন দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী ‘জামাই মেলা’ শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) থেকে শুরু হয়েছে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের রসুলপুর এলাকায় রসুলপুর বাছিরন নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে আগামী রবিবার (২৭ এপ্রিল) রাত পর্যন্ত। এই মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
স্থানীয়রা জানান, সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে প্রতিবছর ১১, ১২ ও ১৩ বৈশাখ রসুলপুরে এই জামাই মেলা বসে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশের অন্তত ৩০ গ্রামের জামাইয়েরা শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে আসেন। তারাই মেলার মূল আকর্ষণ। আর মেলায় জমায়েত হন ৩০ গ্রামের জামাইয়েরা। এ মেলার বয়স দেড়শ’ বছরেও বেশি হবে। এ এলাকার মানুষের কাছে ঈদ বা পূজাপার্বণের মতোই এই মেলা উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। মেলাটি বৈশাখী মেলা হিসেবে ব্রিটিশ আমলে শুরু হলেও এখন এটি ‘জামাই মেলা’ হিসেবে পরিচিত। মেলাকে সামনে রেখে রসুলপুর ও এর আশপাশের বিবাহিত মেয়েরা তাদের স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন। আর জামাইকে মেলা উপলক্ষে বরণ করে নেওয়ার জন্য শ্বশুর-শাশুড়িরা বেশ আগে থেকেই নেন নানা প্রস্তুতি। এছাড়া রসুলপুরসহ আশপাশের গ্রামের যুবকদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করা হয়ে থাকে। এতে করে মেলার পরিবেশ স্বাভাবিক থাকে।
এছাড়া মেলার দিন শাশুড়ি মেয়ের জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে জামাই বাজার করে এনে শ্বশুরবাড়ির লোকদের খাওয়ান। এ কারণেই মেলাটি ‘জামাই মেলা’ হিসেবে পরিচিত। তিন দিনে রসুলপুরসহ আশপাশের গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে এই মেলায়।
শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) বিকেলে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মেলায় বিভিন্ন ধরনের খেলনা, প্রসাধনী, মুড়ি-মুড়কি, আকড়ি, চিনির সাজ, বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকানসহ ছোট-বড় দেড় শতাধিক দোকান বসেছে। মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন দোকানিরা। মিষ্টি জাতীয় পণ্যের দোকানও আছে। এছাড়া এ মেলায় একাধিক ফার্নিচারের দোকানও বসেছে। বড়দের পাশাপাশি ছোট ছেলে-মেয়েরাও এ মেলা উপভোগ করছে। তবে মেলার স্থানটি ছোট হওয়ায় ও প্রচন্ড গরমের কারণে মেলায় আগত দর্শনার্থীদের নাজেহাল অবস্থা। এছাড়া শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) সরকারি ছুটির দিন হওয়াতে মেলায় তিল ধারনের জায়গা নেই। অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে মেলায় ঢুকতে না পেরে মন খারাপ করে ফিরে চলে যাচ্ছে। এদিকে মেলায় কোন ধরনের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই পাশের পেট্রলপাম্পসহ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশেই গাড়ি রেখে মেলায় প্রবেশ করছে।
স্থানীয় রসুলপুর গ্রামের রবীন মিয়া বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখনও দাদার কাছে এই মেলার কথা শুনেছি। বাড়ির মেয়ের জামাইরা মেলাকে কেন্দ্র করে বাড়ি আসায় ও মহাসড়কের পাশে হওয়ায় মেলাটি প্রতিবছর জমে উঠে। এটি টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও বড় মেলা। কালিহাতী থেকে আসা আদর ঘোষ (এলাকার জামাই) বলেন, প্রতিবছরই আমরা শ্বশুরবাড়ি থেকে মেলায় আসার দাওয়াত পাই। এই মেলা আমাদের জামাইদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। মেলাকে কেন্দ্র করে অনেক আত্মীয়র সঙ্গে দেখা হয়, তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয়। সব মিলিয়ে আমরা মেলার এই তিন দিন আনন্দে মেতে উঠি।
টাঙ্গাইল শহর থেকে মেলায় ঘুরতে আসা গৃহিনী তানিয়া আক্তার বলেন, এই মেলাটি একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মেলা শুনে প্রথমবারের মতো ঘুরতে এসেছি। তবে মেলায় কিছুটা অব্যবস্থাপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আশাকরি, মেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলিকে নজরে আনবেন। বিশেষ করে, যদি সম্ভব হয় মেলাটি আরো বড় জায়গায় আয়োজন করলে অনেক সুন্দরভাবে দর্শনার্থীরা এই মেলাটি উপভোগ করতে পারবে। আমি এই মেলার সর্বাঙ্গিন সাফল্য কামনা করছি। মেলায় ঘুরতে আসা স্থানীয় পুণম রাণী বলেন, এটি টাঙ্গাইল জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) দুপুর থেকেই নারী পুরুষ, শিশু থেকে বৃদ্ধ সব শ্রেণি পেশার মানুষ মেলায় ভিড় করছে। তারা বিভিন্নভাবে মেলায় বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কেওবা তাদের পছন্দের সামগ্রী কেনাকাটা করছেন।
মেলায় আসা আকড়ি ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন বলেন, অন্যান্য কাজের পাশাপাশি মেলা আসলে একটু বাড়তি লাভের আশায় কয়েক বছর যাবত এই মেলায় আকড়ি বিক্রি করে আসছি। বর্তমানে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে আকড়ি বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। অন্যান্য মেলার চেয়ে এ মেলা অনেক নিরাপদ।
মেলা কমিটির আহ্বায়ক ও গালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, এবারের মেলায় দেড় শতাধিক দোকান বসেছে। এই মেলায় মিষ্টি জাতীয় খাবার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। মেলায় খাবার আইটেম, খেলনাসহ বিভিন্ন ফার্নিচারও পাওয়া যায়। মেলায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে মেলার নিরাপত্তার জন্য বেশকয়েকজন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তবে প্রচন্ড গরম পড়ায় মেলায় আগত দর্শনার্থীদের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি লোকজনের ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে।