
স্টাফ রিপোর্টার ॥
‘না পোড়াইও রাধা অঙ্গ, না ভাসাইও জলে, মরিলে বাঁধিয়ে রেখো তমালেরই ডালে’- মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলির এমন ভাবসংগীতের আকুলতা বলে দেয় তমাল শুধু ঘন ছায়ার গাছই নয়, এর লতাপাতা, ফুল-ফল আর ডালপালায় জড়িয়ে রয়েছে বিরহী রাধার কাব্যিক প্রেম। রাধা-কৃষ্ণের চিরায়ত প্রেমে বিভোর ভক্তকুলের কাছে তমাল এক পবিত্র বৃক্ষ। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাহাড়ি গ্রাম গুপ্তবৃন্দাবনের এমনি এক সুপ্রাচীন তমাল গাছ ঘিরে হাজারো ভক্ত ও অনুরাগীর প্রেম, ভালোবাসা, মানত, উচ্ছ্বাস দেখা যায়।
জানা যায়, ঘাটাইল-ভালুকা ডায়া সাগরদীঘি সড়কের পাশে অবস্থিত গুপ্তবৃন্দাবন নিয়ে অনেক পৌরাণিক উপাখ্যান রয়েছে। দ্বাপর যুগে কৃষ্ণ-রাধা এখানকার তমাল ডালে প্রেমলীলায় মত্ত হতেন। প্রায় এক বিঘা জমির পুরোটায় অসংখ্য ডালপালা ছড়িয়ে ন্যুজ হয়ে দাঁড়িয়ে সুপ্রাচীন তমালগাছ। গাছের গোড়া টাইলসে বাঁধানো। পর্যটকরা তমালের সুশীতল ছায়াতলে আড্ডা দেন। অনেকেই ভক্তি ভরে গাছের গোড়ায় সাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করেন
সুবিস্তত তমাল তলার পাশেই প্রাচীন শ্রী শ্যাম রায় মদন মোহন বিগ্রহ মন্দির। মন্দির-সংলগ্ন স্থানে নির্মিত হচ্ছে নাটমন্দির। প্রতি বছর মধু কৃষ্ণ ত্রয়োদশীতে মেলা বসে। হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে। দেশ-বিদেশের কৃষ্ণ ভক্ত ছাড়াও সনাতন ধর্মানুরাগীরা সংকীর্তন ও দেব পূজায় নৈবদ্য অর্পণ করেন। সর্বজনীন মেলা, সংকীর্তন আর বাউল সংগীতে মুখর হয়ে উঠে গুপ্তবৃন্দাবন। ১৯৬৫ সালে মন্দির চত্বরে গড়ে উঠে গুপ্তবৃন্দাবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯২০ সাল পর্যন্ত স্থানটি গজারি বনে আচ্ছাদিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে গুপ্তবৃন্দাবনে বেড়াতে এসে ময়মনসিংহ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের কর্মচারী হিমাদ্রী বসাক গভীর জঙ্গল এবং ভূগর্ভে বিরাট কৃষ্ণ পাথর দেখতে পান। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও বনজঙ্গল থাকার কথা বলেছেন বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম।
সড়ক পথে উন্নত যোগাযোগ থাকায় নানা স্থান থেকে পর্যটকরা এখানে বেড়াতে আসেন। দলবেঁধে তমাল ছায়াতলে সময় কাটান, ছবি তোলেন, ভিডিও করেন। গানবাজনা বা নাটকের শুটিংও হয়। সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থেকে এসেছেন অসিত বরন সাহা দম্পতি। বিয়ের এক যুগেও সন্তানের মুখ দেখেননি। মনোবাঞ্ছা পূরণে শ্যাম মন্দিরে বিগ্রহ দর্শনের পর তমাল ডালে লাল সুতো বাঁধেন। জামালপুরের নান্দিনার বিপুল চন্দ্র দম্পতি অসুখ-বিসুখ থেকে নির্বাণের আশায় তমাল ডালে লাল সুতা বেঁধে গেলেন। সিরাজগঞ্জ জেলা শহরের অবিনাশ ও চিত্রা রায় দুই বছর আগে সুতা বেঁধে সন্তানের জন্য মানত করেছিলেন। ৯ মাস আগে কোল জুড়ে আসে ছেলে সন্তান। তাই মন্দিরে পুজো শেষে পুত্রের দীর্ঘায়ু কামনায় তমাল ডালে বেঁধে গেলেন লাল সুতোর গুচ্ছ। মন্দিরের সভাপতি অমূল্য চন্দ্র বৈষ্ণব জানান, লাল সুতা বেঁধে সন্তান লাভ করায় বগুড়ার কমল কাবরা ও শ্রীমতি বালা কাবরা দম্পতি ২০০৮ সালে তমাল গাছের গোড়া টাইলস করে দেন।
তমাল তলার ত্রিমোহনার দোকানদার সোহেল হোসেন জানান, শুধু দম্পতিরাই নয়, স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়ারাও প্রেমে পড়লে তমাল ডালে লাল সুতা বাঁধতে আসেন। গাছের নিচু ডাল লাল সুতায় ভরে যায়। সবুজ পাতার ফাঁকে অসংখ্য লাল সুতা ভালোবাসা আর নিখাঁদ প্রেমের কথাই বলে দেয়। এজন্য তমাল গাছকে প্রেম আর মানত বৃক্ষও বলা হয়।
গুপ্তবৃন্দাবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জসিম উদ্দীন জানান, এই তমাল গাছটি ইতিহাসের সাক্ষী। বয়সের ভারে এক্কেবারে জীর্ণ। অনেকেই পবিত্র বৃক্ষ ভাবেন। গাছের কোটরে হাজারো পাখি ও জবজন্তু নির্ভয়ে আশ্রয় নেয়। গাছের ফল-ফুল, লতাপাতা, শেকড়-বাখড় ভেষজ হিসাবে গণ্য হয়।
মন্দিরের সেবায়েত প্রফুল্ল চন্দ্র বৈষ্ণব জানান, প্রাচীন গাছটি যুগের পর যুগ ধরে সব ধর্ম, বর্ণ ও পেশার মানুষকে বৃক্ষ প্রেমের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের সুতোয় বেঁধে রেখেছে। দিন-রাত অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথাই প্রচার করছে সুপ্রাচীন তমাল গাছ।