
স্টাফ রিপোর্টার, মির্জাপুর ॥
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে খনন না করায় টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর শাখা বারিন্দা নদী নাব্যতা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বছরের পর বছর ধরে উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ঢলের সঙ্গে আসা বালির কারণে নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। কোন কোন স্থানে ভরাট হয়ে উভয় পারের সমতল হয়েছে। নদীতে পলি পড়ে এখন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। নদীর গতিপথ লোপ পেয়ে খালে পরিণত হওয়ায় হুমকির মুখে পড়ছে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য। পানির অভাবে দেশীয় প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে।
জ্যৈষ্ঠ মাসের এই সময়ে উপজেলার উয়ার্শী ইউনিয়নের মল্লিক মার্কেট, সাফর্তা, নওগাও ও বারিন্দ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নদীর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল, অটোরিক্সা ও ভ্যান চলাচল করছে। নদীর মাঝে খড়ের স্তুপ করে রাখা হয়েছে। এছাড়া পায়ে হেটে লোকজন এই নদী পার হচ্ছে। অথচ উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত বংশাই ও লৌহজং নদীতে এখন পানি ভরপুর।
এলাকার লোকজন জানান, নৌকা ও নদী একে-অপরের পরিপূরক। নদীতে মূলত নৌকা চললেও লঞ্চ, স্টিমার, স্পীডবোট, ট্রলার ইত্যাদিও দেখা পাওয়া যায়।
প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ নদ নদীর তীরবর্তী সমতলভূমিতে বসবাস শুরু করে। নদীকে ঘিরেই বিশ্বের প্রতিটি শহর, বন্দর, বাজার প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। এভাবে বড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা, কর্ণফুলীর তীরে চট্টগ্রাম, শীতলক্ষ্যার তীরে নারায়নণগঞ্জ, সুরমার তীরে সিলেট, গোমতীর তীরে কুমিল্লা ইত্যাদি লক্ষ করা যায়। নদ-নদীই মানুষের খাদ্য ও রোজগারের প্রধান উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করে। মালামাল পরিবহন ও যোগাযোগের সহজ উপায় ছিলো নৌকা। মালামাল পরিবহনে খুবই স্বল্প খরচে নৌকার জুড়ি মেলা ভার। যিনি নৌকা চালান তিনি মাঝি হিসেবে পরিচিত। একসময় নৌকায় পাল তোলা থাকত। সময়ের বিবর্তনে এর স্থান দখল করেছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা, স্টিমার। মাঝ নদীতে জেলেরা উত্তাল তরঙ্গের সাথে যুদ্ধ করে মাছ আহরণ করতো। নদী পাড়াপাড়ে ইজারাদার কর্তৃক কর হিসেবে টাকা আদায় করা হতো। বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতার সূত্রপাত হয় নদীকে কেন্দ্র করে।
একসময় বারিন্দা নদীর প্রশস্ত প্রায় ৬০০ ফুট ছিল। নদীতে স্রোত ছিল। নদীতে সারা বছর পানি থাকত। নাগরপুর, সিরাজগঞ্জসহ উত্তর পশ্চিম এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে এই নদীতে সারা বছর বড় বড় মালবাহী লঞ্চ ও ইঞ্জিন চালিত মালবাহী নৌকা নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করতো। এছাড়া স্থলপথ না থাকায় মানুষ নদীপথে নৌকায় গন্তব্যে যাতায়াত করতেন। এখন আর তার কোনোটাই নেই। নদীর নাব্য হারানোর পাশাপাশি নদীতে অপরিকল্পিতভাবে সেতু নির্মাণ করায় নৌ-বাণিজ্য বলতে এখন এর কোনো কিছু নেই। নদীতে পানি না থাকায় বোরো মৌসুমে সেচের কাজে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া নদী ভরাট হয়ে গতিপথ বন্ধ হওয়ায় ভারী বর্ষণের সময় প্লাবিত হচ্ছে নদীতীরবর্তী এলাকা।
কৃষক শওকত হোসেন জানান, বারিন্দা নদীর প্রশস্ত ছিলো প্রায় ৬০০/৭০০ ফুট। তারা আগে নদীর পানি দিয়ে সারা বছর ঘর গৃহস্থালির কাজ করতেন। বোরো ফসলের মাঠে সেচ দেওয়ার কোনো চিন্তা করতে হতো না। নদীতে মালবাহী বড় বড় লঞ্চ চলাচল করেছে। লঞ্চে নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত যাতায়াত করেছি। এখন খালে পরিনত হয়েছে। ভড়াট হওয়ায় নদীর মাঝে খড়ের স্তুপ করে রেখেছেন বলে জানান। আগৈত গ্রামের বাসিন্দা নৌকার মাঝি জতীন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, ৪০ বছর ধরে নৌকা চালান। নদীটি ভরাট হওয়ায় নৌকা চলাচল বন্ধ রয়েছে। খননের দাবি জানান তিনি। একই এলাকার মুন্নেছ মিয়া বলেন, এই নদীতে স্র্রোত ছিলো। নৌকায় পার হলে ভয় লাগতো। চৈত্র মাসেও খেয়া চলেছে। এখন খালও নেই। কার্তিক মাসেই শুকিয়ে চড় পড়ে। জ্যৈষ্ঠ মাসের সাত দিন পার হচ্ছে তারপরও পানির দেখা নেই।
নওগাও গ্রামের কৃষক ময়নাল মিয়া বলেন, নদীটি খনন করা দরকার। এতে নদীপথে বাণিজ্য বাড়বে। চৈত্র মাসে কৃষক জমিতে পানি দিতে পারে না। নদীতে পানি থাকলে এলাকার কৃষক জমি চাষে উপকৃত হবে। আরও জানান, এলাকার জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় তারা তা করতে পারছেন না। নদী শুকিয়ে যাওয়াতে এখন অনেক জায়গায় ধান লাগানো হয়। প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক খন্দকার মাসুদ পারভেজ বলেন, নদী রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন প্রধান প্রধান নদী দ্রুত খনন করা প্রয়োজন। নদীর উৎসমুখগুলো খনন করলে সুফল পাওয়া যাবে এবং সারা বছর নদীতে পানি থাকবে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বারিন্দা নদী খননের কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। তবে নদীটি জরুরি ভিত্তিতে খনন প্রয়োজন।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
মুঠোফোনের কল রিসিভ না করায় টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হকের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।