
স্টাফ রিপোর্টার ॥
মেলা আর পালাপার্বণের দেশ বাংলাদেশ। বউমেলা, জামাই মেলা, মাছের মেলা, বই ও বৈশাখী মেলা ছাড়াও দুর্লভ ফকির মেলার দেখা মেলে টাঙ্গাইল জেলায়। সামাজিক বিবর্তনে বাঙালির জীবনধারা পালটে গেলেও লৌকিক বিশ্বাসভিত্তিক আদি সংস্কৃতির ফকির মেলা এখনো টিকে রয়েছে। মেলার সঙ্গে সুস্থ বিনোদন ও গ্রাম্য অর্থনীতি জড়িত থাকলেও ফকির মেলায় মানবিকতার উচ্ছ্বাস আর আসমানি বালামুছিবত দূরের বাসনা জড়িত।
সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায়, যারা ভাত-কাপড় জোটাতে অন্যের কাছে হাত পাতেন, তারাই ভিখারি। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে এদেরকে বলা হয় ফকির। মিসকিন বা দেওয়ান নামেও পরিচিত। ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে বলা হয়, বাংলায় ফকির বা মিসকিন শব্দের সঙ্গে দুর্ভিক্ষ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলায় যতবার দুর্ভিক্ষ হয়েছে, ততবারই ভিখারির সংখ্যা বেড়েছে। ইতিহাস প্রমাণ দেয়, নবাবি শাসনামল পর্যন্ত বাংলা ছিল ধনধান্যে পুষ্পে ভরা। সুলতানি আমলে বাংলা থেকে কোটি কোটি টাকা আরব দেশে খয়রাতি হিসেবে পাঠানো হতো।
ইংরেজ শাসনামলে বাংলায় প্রথম দুর্ভিক্ষ হয়, যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এরপর ১৯৪৩ ও ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ প্রাণ হারায়। দুর্ভিক্ষে প্রাণহানি ছাড়াও বহু মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামায়। এরপর বাঙালিকে ভিক্ষুকের জাতি বলে উপহাস শুরু হয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও বাংলাদেশ এখনো ভিক্ষুকমুক্ত নয়।
আশির দশক পর্যন্ত বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টির ফসলহানিতে হাভাতিয়া মানুষ থলে নিয়ে ঘুরতেন। গৃহস্থরা চাল-ডাল ভিখ দিতেন। মরা কার্তিকে অনাহারে অখাদ্য, কুখাদ্য খেয়ে মারা যেত। সেই সময়টাতে দিনহীন মানুষকে এক বেলা পেট পুরে খাওয়াতে অবস্থাপন্ন গৃহস্থরা দশ গ্রামের নিরন্ন মানুষকে জেয়াফত দিতেন। সারি সারি ডেকচিতে রান্না হতো গরুর মাংসের সালুন। বহির্বাটিতে খড় বিছিয়ে চলত ভোজ। বিদায়বেলা বাড়তি খাবার আর নগদ বকশিশ গছিয়ে দিতেন।
টাঙ্গাইলে নিরন্নকে জেয়াফত দিয়ে খাওয়ানোর ইতিহাস দশকের পর দশক জুড়ে। এটি পরে লৌকিক রেওয়াজে পরিণত হয়। এ রীতির নাম ফকির মেলা। সম্প্রতি এমন ফকির মেলা অনুষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ী ইউনিয়নের পঁচিশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। সেখানে জনা পঞ্চাশেক ফকির তৃপ্তিসহকারে মেন্দা ভাতে ভোজ সারেন।
মেলার আয়োজক ছিলেন পঁচিশা গ্রামের প্রবীণরা। গ্রামের বাসিন্দা এবং ছাত্রনেতা আমিনুল ইসলাম আখতার জানান, কয়েক দশক ধরে চৈত্র মাসে ফকির মেলার আয়োজন হয়। গ্রামবাসী যেন সারা বছর সুখ-শান্তিতে থাকেন, সেই লক্ষ্যে ভোজপর্বে অংশ নেওয়া ফকিররা কিছু লৌকিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। ভিক্ষুক মোকাদ্দেস আলী শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য পাঁচ দশক ধরে ভিক্ষা করেন। তিনি জানান, আগে সব গ্রামেই ফকির মেলা হতো। ভোজে অংশ নিতেন দুই-তিন শত ফকির। কিন্তু বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতাসহ নানা সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা জোটায় সারা উপজেলা খুঁজেও ৩০/৩৫ জনের বেশি ফকির মেলে না। এজন্য মেলায় ফকিরের উপস্থিতি কমে যাচ্ছে।
ভিখারি সমশের আলী জানান, ফকির মেলায় কিছু লৌকিক রীতি মানা হয়। আসমানি ও জমিনি বালা-মুছিবত নিরসনে কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জিকির তুলে পাড়াময় চক্কর দেওয়া হয়। এতে গ্রাম থেকে সব বালা দূর হয়। আগে কার্তিকে মেলা বসত, এখন বসে চৈত্রে।
লোকসংস্কৃতি গবেষক অধ্যাপক ড. সোলায়মান হোসেন জানান, টাঙ্গাইলে ফকির মেলা এখন খুব একটা দেখা যায় না। মূলত কিছু লৌকিক বিশ্বাস ও রীতিনীতির ওপর ভর করে এ লোকসংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। ইতিহাস বলে, বিদেশি শোষণে সোনার বাংলা যেমন দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। তেমনি জনগোষ্ঠীর এক অংশকে থালা হাতে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে।