
সাদ্দাম ইমন ॥
চুল-দাঁড়ি কাটার কারণে যুগের পর যুগ ধরে নরসুন্দরদের কদর ও প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। চুল-দাঁড়ি কেটে মানুষকে সুন্দর করাটাই একমাত্র কাজ বলে তাদেরকে নরসুন্দর বলা হয়। এক সময় টাঙ্গাইলের গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারে পিঁড়িতে বসে বৃদ্ধ, যুবক ও ছোট্ট বাচ্চাদের চুল কাটার ব্যস্ত সময় পার করত নাপিত বা নরসুন্দররা। একটি কাঠের বাক্সে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি, সাবান, ফিটকারি, পাউডার ও বসার জন্য থাকত জল চৌকি কিংবা পিঁড়ি। এগুলো দিয়ে মানুষকে বসিয়ে গলায় লাল বা সাদা কাপড় পেঁচিয়ে মাথাকে দুই হাঁটুর মাঝে ঢুকিয়ে পিতলের চিরুনি আর কাঁচি দিয়ে কাটতেন চুল। আশি ও নব্বইয়ের দশকে এভাবে পিঁড়িতে বসিয়ে গ্রামবাংলার মানুষের চুল-দাঁড়ি কাটার সেই পরিচিত দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না।
সভ্যতার বির্বতনে মানব জীবনের গতিধারায় পরিবর্তন ও নতুনত্বের ছোঁয়াই জেন্টস পার্লারগুলোতে বাহারি রংঙের হেয়ার স্টাইলের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে হাট- বাজারে পিঁড়িতে বসা সেলুনগুলো। আধুনিতায় সেই সকল নরসুন্দরদের স্থান দখল করে নিয়েছে নামি দামি সেলুনগুলো। আধুনিক সভ্যতায় গড়ে উঠেছে আধুনিক ও উচ্চমানের সেলুন। তারপরেও আধুনিক ও স্মাট যুগে এসেও এখনো টাঙ্গাইলের বিভিন্ন প্রান্তের হাট ও বাজার কিংবা গ্রামগঞ্জের জলচৌকি, পিঁড়ি বা ইটের ওপর সাজানো পিঁড়িতে বসে চুল ও দাঁড়ি কাঁটেন নরসুন্দরেরা।
টাঙ্গাইলের করটিয়া ইউনিয়নের হাট ও বাজার এলাকায় পিঁড়িতে বসে চুল ও দাঁড়ি কাটানোর চিরচেনা দৃশ্য এখনও চোখে পড়ে যায়। পিঁড়িতে বসে অল্প খরচে এখনো তাদের কাছে অনেকেই চুল ও দাঁড়ি কাটান। নরসুন্দর প্রদীপ চন্দ্র শীল (৭০) ও মনোরঞ্জন চন্দ্র শীল (৬০)। এ দু’জন একে পরের সহযোদ্ধা। বংশ পরিক্রমায় নরসুন্দর হয়েছেন। এই সহযোদ্ধা দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এ পেশায় আছেন। প্রদীপ চন্দ্র শীলের তিন ছেলে আধুনিক ও উচ্চমানের সেলুনের দোকানে থাকলেও তিন ছেলের আলাদা সংসার থাকায় তিনি এই বৃদ্ধ বয়সে এখনও এই বাজারের এককোণে পিঁড়িতে বসে মানুষের চুল ও দাঁড়ি কেটে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। একই অবস্থা মনোরঞ্জন চন্দ্র শীলেরও। তার দুই ছেলে বাজারে সেলুনের দোকান থাকলে ছেলের আয়ে জোটে না জীবন-জীবিকা। তাই তিনিও বৃদ্ধ বয়সে তার পথ চলার সহযোদ্ধা প্রদীপ চন্দ্র শীলের সঙ্গে খোলা আকাশের নিজে বসে মানুষের চুল-দাঁড়ি কাটেন। এভাবেই তাদের জীবন-জীবিকা চলে।
এখনো বাজারে জলচৌকিতে বসে কাঠের বাক্স যার মধ্যে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি, সাবান, ফিটকিরি, পাউডার ও লোশন নিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষকে সুন্দর করে যাচ্ছেন। অনেক বছর আগে চুল কাটা বাবদ নিতেন চার পয়সা আর দাঁড়ি কাটার জন্য দু পয়সা। সে সময় যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলতো। কিন্তু বর্তমানে ৩০ টাকায় চুল ও ১৫ টাকা দাঁড়ি কেটেও সারা দিন যে টাকা উপার্জন হয় তা দিয়ে সাংসার চালানো তাদের হিমশিম খেতে হয়। প্রদীপ চন্দ্র শীল (৭০) ও মনোরঞ্জন চন্দ্র শীল (৬০) আরও জানান, পূর্বে আমরা বার্ষিক চুক্তিতে কাজ করতাম। কিন্তু বর্তমানে সেই নিয়ম নেই। তারা আক্ষেপ করে জানান, বর্তমানে যে পরিবর্তন এসেছে চুল-দাঁড়ি কাটার সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতিও পরিবর্তন হয়েছে। সেসব সেলুনে এখন আর শান দেওয়া ক্ষুর দেখাই যায় না। তার বদলে এসেছে ব্লেড লাগানো ক্ষুর। এখন এসেছে চুল কাটানো মেশিন, শেভিং ক্রিম, লোশন, চুলের কলপ। আমরা যখন বাপ-দাদার কাছে কাজ শিখে নিজেরাই কাজ শুরু করি তখন এগুলো আমাদের কাছে ছিল কল্পনাতীত। ছেলেদের আধুনিক সেলুনের দোকান থাকলেও তাদের সংসারে ঠাঁই মেলেনি। তাই এ বৃদ্ধ বয়সে একদিকে বাপ-দাদার পেশাটা ধরে রাখার লড়াই ও অন্য দিকে জীবন-জীবিকার তাগিদে রোদ-বৃষ্টিতেও চুল-দাঁড়ি কাটান তারা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা এই লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন বলে জানান এই দুই নরসুন্দর।
স্থানীয় নুরজামাল মিয়া বলেন, এখন তো বিভিন্ন হাট-বাজারে অনেক আধুনিক সেলুন আছে। কিন্তু যখনই বাজারে যাই, ওই চুল কাটা দেখলে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। কারণ তারা যখন চুল কাটতো, দুই হাঁটু দিয়ে আমাদের চাপ দিয়ে ধরতো, যেন নড়াচড়া না করতে পারি। ফলে যখন চুল কাটতো, তখন তার হাঁটুর ওপর ঘুমিয়ে পড়তাম। চিরচেনা দৃশ্য ছোট বেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। অন্য এলাকায় আছে কি না আমাদের জানা নেই। তবে আমাদের এলাকায় কয়েকজন নরসুন্দর থাকায় আমরা এখনও মাটিতে বসা নরসুন্দুরদের কাছে চুল-দাঁড়ি কেটে নেই। সেখানে শিশু-কিশোররাও তাদের কাছে চুল কেটে নেন।
স্কুলের অধ্যক্ষ আব্দুল হানিফ সরকার বলেন, আমরা ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে যেতাম। চুল কাটাতে তাদের দায়িত্ব দিয়ে বাবা বাজারের সব কাজ শেষে আসতেন। এখন আর তাদের কাছে চুল-দাঁড়ি কাটায় না। এখনকার ছেলে-মেয়েদের চুল কাটায় আধুনিক সেলুনগুলোতে। আমরা এখনো এ দৃশ্য নিজের চোখে দেখলেও এমন একটা সময় আসবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিছকই গল্পই মনে হবে।
সদর উপজেলার এমনই একজন নরসুন্দর হলেন মহিনী শীল (৫৫)। তিনি তার পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যগত পেশা টিকিয়ে রেখেছেন। তার পিতা কালিপদ শীল এর মৃত্যুর পরে তিনিই এখন বিভিন্ন হিন্দু পাড়ায় ঐতিহ্যগতভাবে নরসুন্দরের কাজ করছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিয়ে, শ্রাদ্ধ, শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পরবর্তীতে সেই সব বাড়িতে ডাক পড়ে তার। তিনি বলেন, ৪০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। বাপ দাদার রেখে যাওয়া আদি পেশা তাই ধরে রেখেছি। এখন আর ব্যবসা নেই। তখন ধানের বিনিময়ে চুল দাঁড়ি কেটে দেওয়া হতো। বছর শেষে দেড়-দুইশ মণ ধান পেতাম। তরিতরকারীও খুব একটা কিনা লাগত না। ওই দিনগুলোই ভালো ছিল। এখন দিন শেষে ৯০-১০০ টাকা কাজ করতে পারি। আমার কাছে যারা আসেন তাদের বেশির ভাগই বয়স ষাটের ঊর্ধ্বে। তিনি আরো বলেন, আগে সাপ্তাহিক হাট-বাজার ছাড়াও সারা বছর মানুষ আমাদের বাড়িতে এসে বাবার কাছে পিঁড়িতে বসে চুল কাটাতো। চুলের কি স্টাইল হবে তা মুরুব্বিরা ঠিক করে দিতো। অনেকে এসে বলতেন মাথা একেবারে মুন্ডন করে দিবে। মুন্ডন মানে ন্যারা করে দেওয়া। চুল হাতে ধরা যাবে না। কারো চুল সামনে দিয়ে একটু বড় হলে মুরুব্বিরা আবার বাচ্চার কান ধরে নিয়ে আসতেন। এক সঙ্গে চার-পাঁচজন মানুষ আসতেন, তখন অনেক জাঁকজমক ছিল।
নর সুন্দর রাধা শীল (৬০) বলেন, ৪৭ বছর ধরে বাপদাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছি। ১০ পয়সা থেকে চুল দাঁড়ি কাটার কাজ করছি। এখন আর তেমন লোকজন হয় না। হাট বাজারের আনাচে কানাচে সেলুন ও জেন্টস পার্লার গড়ে উঠেছে। সেখানে কাঁচির পরিবর্তে মেশিন দ্বারা চুল কাটায় মধ্য বয়স্করা পর্যন্ত সেখানেই চুল দাঁড়ি কাটতে ভীড় করেন। তারপরও আমাদের নিকট যে কয়জন আসে তারা বয়স্ক লোকজন। ফলে আমরা যারা, পূর্বপুরুষের পেশা ধরে আছি তাদের ব্যবসা কমে গিয়ে দিন চলা কঠিন হয়ে গেছে।
টাঙ্গাইল জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে পিঁড়িতে বসা নরসুন্দরদের পাওয়া গেলেও কাজের খড়ায় ভুগছেন তারা। তাই অনেকেই পেশা বদলীয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন বলে জানান। অপরদিকে সময়ের সঙ্গে সেলুন পেশার চাকচিক্য ও কদর বেড়েছে। বেড়েছে আয়। কমেছে হাট-বাজারে বট বৃক্ষের শীতল ছায়ার নিচে কিংবা প্রখর রোদ্রে লোহার উঁচু শিখে টানানো ছাতায় ঘেরা পিঁড়িতে বসা সেলুনের। তাই এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জে গাছের নিচে পিঁড়িতে বসা সেলুনগুলো। হয়ত ধীরে ধীরে এগুলো একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।