
স্টাফ রিপোর্টার ॥
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে বসতঘরে পেট্রোল ঢেলে মা ও তিন মেয়েকে পুড়িয়ে মারার বিভীষিকাময় সেই ঘটনার এক যুগ হয়ে গেলেও শেষ হচ্ছে না বিচার কাজ। প্রধান আসামি ছাড়া সকল আসামি জামিনে বের হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেশের আলোচিত ও মর্মান্তিক এই ঘটনার বিচার কাজ কবে শেষ হবে তা কিছুই জানেন না মামলার বাদী ও নিহতের পরিবার। স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় রাতের আধারে ঘরে পেট্রোল ঢেলে মা ও তিন মেয়েকে হত্যা করা হয়।
বিগত ২০১৪ সালের (৭ অক্টোবর) ঈদুল আজহার রাতে মির্জাপুর উপজেলার সোহাগপাড়া গ্রামে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় বসতঘরে পেট্রোল ঢেলে ঘুমন্ত অবস্থায় মা হাসনা বেগম ও তিন মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী মনীরা (১৪), বাক প্রতিবন্ধী মীন (১১) ও নার্সারির ছাত্রী মলিকে (৭) পুড়িয়ে হত্যা করে জাহাঙ্গীর আলম নামে এক পাষন্ড ও তার সহযোগীরা। ঘাতক জাহাঙ্গীর ঘটনার দিন সন্ধ্যায় এক রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে স্থানীয় মাছরাঙা ফিলিং স্টেশন থেকে প্রায় ৩০ লিটার পেট্রোল কিনে আনেন। জাহাঙ্গীর একই গ্রামের বাহার উদ্দিনের ছেলে। নিহত হাসনা বেগমের স্বামীর নাম মজিবর রহমান। ঘটনার দিন তিনি মালয়েশিয়া ছিলেন। স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিহতের খবর পেয়ে পরদিন দেশে ফিরে আসেন প্রবাসী মজিবর।
ঘটনাস্থল সোহাগপাড়া গ্রামে চাঞ্চল্যকর মামলার বর্তমান বাদী হাসনা বেগমের পিতা আলাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ঘটনার পর মির্জাপুর থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী ছিল আমার ছেলে (নিহত হাসনার ছোট ভাই) মোফাজ্জল হোসেন। সে তিন বছর আগে চাকরির উদ্দেশে বিদেশে চলে যাওয়ায় বাদী পরিবর্তন করে বর্তমানে মামলাটির বাদী আলাল উদ্দিন নিজেই হয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ঘটনার পর মির্জাপুর থানায় মামলা হলে তদন্ত কর্মকর্তা মির্জাপুর থানার তৎকালীন এসআই শ্যামল দত্ত আসামী জাহাঙ্গীর ও তার সহযোগী নুর মোহাম্মদ দিপু এবং যেখান থেকে পেট্রোল আনা হয় সেই পেট্রোল পাম্পের ম্যানেজারসহ চার কর্মচারীকে আসামি করে চার্জশীট দেন। জাহাঙ্গীরের অপর সহযোগী হারুন অর রশিদ রাজীবকে মামলা থেকে বাদ দেওয়ায় আদালতে নারাজি দেন বাদী।
পরে মামলাটি তদন্ত করতে সিআইডিকে দেওয়া হয়। সিআইডির প্রতিবেদনেও বাদী নারাজি দিলে আদালত চার্জ গঠন করে হারুনের নাম যুক্ত করে বিচার কাজের প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু এই চার্জের বিরুদ্ধে আসামি হারুন অর রশিদ রাজীব উচ্চ আদালতে শরণাপন্ন হলে উচ্চ আদালত চার্জের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দেন। ফলে মা ও তিন মেয়েকে পুড়িয়ে হত্যার আলোচিত মামলাটি বিচারিক আদালতে থেমে যায়। বর্তমানে মামলাটি চলমান হয়ে বিচারিক কাজ চলছে টাঙ্গাইল জর্জকোর্ট এডিশনাল ১ এর আদালতে।

বাদী আলাল উদ্দিন আরও জানান, এরই মধ্যে মামলার বেশ কয়েকজনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে এবং বাকি সাক্ষ্য সামনে নেয়া হবে। বর্তমানে মামলার শুধু তারিখ পড়ছে। আগামী (২৯ অক্টোবর) তারিখ আছে বলে তিনি জানান। তবে এই মামলার বিচার কবে শেষ হবে, তা কিছুই জানেন না বলে জানান মামলার বাদী আলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, প্রধান আসামি জাহাঙ্গীর ছাড়া সব আসামি জামিনে আছে। বর্তমানে এ মামলায় আটজন আসামি রয়েছে বলে তিনি জানান।
মির্জাপুর উপজেলার সোহাগপাড়া গ্রামে সেই বসতবাড়িতে কথা হয় হাসনা বেগমের স্বামী মজিবর রহমানের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একজন বাদে সব আসামি বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিচার কবে শেষ হবে কিছুইতো বুঝতেছি না। আমার স্ত্রী ও তিন মেয়ে পেট্রোল দিয়া মারলো। তার বিচার হয় না কেন প্রশ্ন করে আক্ষেপ করেন তিনি। এ সময় এই প্রতিবেদককে তার বসতঘরে ডেকে নিয়ে স্ত্রী ও তিন মেয়ের টাঙানো ছবি দেখিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। কথা হয় নিহত হাসনা বেগমের শ্বাশুড়ি জপা বেগমের সঙ্গে। প্রতিবেদককে দেখেই বলে উঠলেন কত বারতো আইলেন কিছুইতো হইলো না। ছেলের বউ ও নাতনীদের কথা মনে পড়ে নীরব হয়ে গেলেন জপা বেগম। ঘরের যে কক্ষে পেট্রোল দিয়ে আগুন লাগিয়েছিল তার পাশের কক্ষেই হাসনার শাশুড়ি জপা বেগম ও শ্বশুর চান মিয়া ঘুমিয়েছিলেন। ঘটনার কয়েক বছর পর চান মিয়া মারা যান।

মামলার আইনজীবী টাঙ্গাইল জর্জকোর্টের এডিশনাল পিপি অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান স্বপন বলেন, মা ও তিন মেয়েকে ঈদের দিন রাতে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনাটি দেশের একটি আলোচিত মামলা। এই চলমান মামলায় বেশ কয়েকজনের সাক্ষী হয়েছে। তবে কিছু সাক্ষী এখনো বাকি আছে বলে তিনি জানান।






