এম কবির ॥
ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ, আত্মার পরিশুদ্ধি। ‘আওদ’ শব্দ থেকে ঈদের উৎপত্তি। আরো বলতে গেলে, ঈদ মানে কেবল আনন্দময় দিনই নয়। ঈদ একটি ইবাদত, যা দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজে ছয় তাকবিরে পড়তে হয়। ঈদে সামাজিক বা পারিবারিকভাবে কাউকে সম্ভাষণে ‘ঈদ মোবারক’ বলা হয়। মোবারক মানে কল্যাণময়। তার মানে, ঈদ মোবারক অর্থ হলো- আনন্দ উদযাপন কল্যাণময় হোক।
ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, ভেদাভেদ ভুলে সৌহার্দ্য ও সংহতি প্রকাশের এক উৎসব হলো ঈদ। বৃহত্তম উৎসবের দিন হিসেবে মুসলমানরা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালন করেন। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ৬১০ সালে হেরাগুহায় নবুয়তপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে যে আদর্শ, জীবনবোধ, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আচার-আনুষ্ঠানিকতা মুসলিম উম্মাকে দিয়ে গেছেন, তারই ধারাবাহিকতায় চলে আসছে ধর্মীয় মূল্যবোধ, অনুশাসন হয়ে শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে। দুটো ঈদই প্রবর্তন হয় হিজরি দ্বিতীয় সনে। দ্বিতীয় হিজরিতে বদরের যুদ্ধ বিজয়ের ১৩ দিন পর পহেলা শাওয়াল ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়।
১০ জিলহজ ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালন করা হয়। ঈদের নামাজ দুই রাকাত, যা পুরুষদের জন্য ওয়াজিব। এই নামাজে ছয়টি অতিরিক্ত ওয়াজিব তাকবির আদায় করতে হয়। নামাজ শেষে খুতবা শোনা ওয়াজিব।
পবিত্র কোরআন ও সহিহ হাদিসের তথ্য মতে, পবিত্র ঈদুল আজহার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিগূঢ় ইতিহাস, যার সূচনা হয়েছিল বাবা আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের প্রতিযোগিতামূলক কোরবানি করার মাধ্যমে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য বাবা হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দিতে গিয়ে দুম্বা কোরবানি হয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় চলে এসেছে পশু কোরবানি।
হিজরি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ পালিত হয় ঈদুল আজহা। হজরত ইব্রাহিম ( আ.) মহান আল্লাহপাকের কাছে স্বীয় ইচ্ছাকে সমর্পণ করার মধ্য দিয়ে স্থাপন করেছেন তার আদর্শকে। নিজ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর নামে কোরবানি দিতে উদ্যত হলে আল্লাহপাক জিবরাইল ফেরেশতা মারফত দুম্বা কোরবানির কথা সবার জানা। ঈদুল আজহা বা ইয়াওমুন নার। আর কোরবানি হলো ‘সুন্নাতে ইব্রাহিম’। ইসলামি তথ্য মতে, ঈদুল আজহার দিন সকালে যার কাছে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সমপরিমাণ অর্থ আছে, তার ওপর ঈদুল আজহার কোরবানি করা ওয়াজিব। দশ দিন আগে উদিত হওয়া চাঁদ দেখে নির্ধারিত হয় ঈদুল আজহার তারিখ।
বয়স বাড়ার সঙ্গে মজা বা আনন্দের ধরনও পাল্টায়। জীবন ও জীবিকার তাগিদ ছিটকে নিয়ে এসেছে গ্রামের ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, শান্ত দিঘির জলের নীরবতাকে পেছনে ফেলে শহুরে জীবনের ইটপাথরের বন্দি কোঠরে। ছেলেবেলাটা যাদের গ্রামে কেটেছে, তাদের ঈদ উদযাপনের স্মৃতি শহুরে জীবনে ঈদের সঙ্গে মিলবে না কোনো দিন। গ্রাম মানে মা-মাটি, প্রকৃতির সঙ্গে বেড়ে ওঠার উপাখ্যান।
ক্যালেন্ডারের পাতা দেখে নয়, মোবাইল বা ইন্টারনেট ছিল না তখন, মা-বাবা, বয়োজ্যেষ্ঠদের বারবার জিজ্ঞেস করে জানা হয়েছে, ‘দাদু, বরহা ঈদ কবে আইবো?’
গ্রামে বেশির ভাগ ঘরের পালা বা পোষা গরুই কোরবানি দেওয়া হতো। হাল চাষে অক্ষম বলদ গরু, কিংবা ‘হরুল্যেয়া’ মানে বাছুর হয় না যে মাদি গরু, তাকেই কোরবানি হিসেবে রাখা হতো। যাদের অতিরিক্ত গরু থাকত না, তারা বাজার থেকে কয়েকজন মিলে শরিক হয়ে গরু কিনে কোরবানি দিতেন। বাজার থেকে গরু কিনতে শরিকরাসহ ‘পাইকার’ ধরতে হতো। পাইকাররা খুব চালাক হতো। পরনে সাদা টেট্রন কাপড়ের লুঙ্গি, মাথায় চিক চিক করে সরিষার তেল দেওয়া, বুকের দু-একটা বোতাম খোলা, হাতে একটা ছাতা, মুখে পান, চোখের ভ্রু বারবার এদিক-ওদিক ঘুরানোর মানুষটিই হতেন পাইকার। বাজারে গিয়ে গরুর লাইনে দাঁড়িয়ে গরুর লেজ ধরে নাড়া মারতেন, তাতে গরু লাফ মেরে উঠে দৌড় মারতে চাইত। গরু বিক্রেতা বলত, ‘গরুডা ছেরির মা পালত, আতের গরু, দেশি, চাইরটা দাঁত গরুডার। নিলে ঠগদাইন্যেয়া।’ আমরা যারা ছোটরা বড়দের অনেক বলে কয়ে, তাদের ফুটফরমাস কেটে তারপর বাজারে যাওয়ার অনুমতি পেতাম, বাজারে গরুর পায়ের শক্ত পাড়া খেয়েও চুপ হয়ে থাকতাম, পরে যদি বকে, কেন আসলাম বাজারে? গরু কেনার পর পুরো রাস্তা গরুর পিছে পিছে আধা দৌড়ে হেঁটে আসতাম। কেউ দেখলেই জিগ্যাস করতো, ‘ভাই, গরুডার দাম কত?’ রাস্তায় গরুর দাম বলতে বলতে গলা শুকিয়ে যেত। জোরে গরুর পেছনে হাঁটতাম আর চিন্তা করে কুল পেতাম না, ষাঁড় বলদ হয় কেমনে? বড়দের জিজ্ঞেস করলে ধমক দিয়ে বলত, ‘বলদ অইছে ছেঁড়াডা, জোরে হাঁট…।’
গরু জবাই হলে তার পর্দা দিয়ে ঢোল বানাতে আমাদের আয়োজন শুরু হয়ে যেত। ভাঙা কলসির কান্দা সংগ্রহ করা ছিল এক নম্বর কাজ। গরুর পেটের অংশের পর্দা কখন বের করব, তার জন্য বড়দের পিছু পিছু হাঁটতাম, বড়রা যা বলত, তখন তা-ই করে দিতাম। জবাইয়ের পর গরুর চামড়া ছিলার সময় বড়দের সঙ্গে গরুর ঠ্যাং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। গরুর পর্দা কলসির কান্দায় লাগিয়ে রোদে শুকাতে দিতে হয়। পর্দা শুকানোর পর কচুগাছের ডাঁটা দিয়ে ডব ডব করে ঢোল বাজাতাম। এটা না হলে যেন ঈদই মাটি। দুপুরে জবাই করা গরুর কলিজা রান্না হতো, যা চালের রুটি দিয়ে খেতে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করতাম। মাংস সেদ্ধ হলো কি না, তা চেঁকে দেখে সবার আগে কোরবানির মাংস খাওয়া ছিল আনন্দ, খুশির অংশ।
সে সময়ের অভিভাবকরা এখনকার বাবা-মাদের মতো বললেই বাচ্চাদের কিছু কিনে দিতেন না। মাসের পর মাস ধরে চাইতেই হতো। নতুন জামা, হাফপেন্ট বা জুতা কিনলে আগেরটা কেমন ছিঁড়ছে, কতটুকু প্রয়োজন, তা যাচাই করে তারপর কিনার সম্মতি। তাতেও শর্ত থাকত, ক্লাসে ভালো রেজাল্ট, কথা শোনা, আরো কত কি।
ছেলেবেলার সব কথা, সব স্মৃতি পুরোপুরি মনে আসে না। মনের ডায়াফ্রামে আটকে থাকে, হারিয়ে যায়। তখন নামাজ বুঝতাম না। সবার সঙ্গে সেজদায় গেলে মাথা উঁচিয়ে দেখতাম, কেমন দেখা যায়। মানুষের চিন্তাধারা বদলে গেছে এখন। উপার্জন, দৃষ্টিভঙ্গি, জীবন-জীবিকা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
মনের পশুকে দমন করার জন্য পশু কোরবানিকে আল্লাহপাক একটি শিক্ষা হিসেবে দিয়েছেন মানুষকে। সত্যিকারে কজন মানুষ নিজেকে শোধরাতে পারে? ভালো মানুষের আড়ালে দূর্জনরা ঘাপটি মেরে থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই একজনের পেছনে লেগে থাকা, অপছন্দ করা, থাকে হেয় করা, ছোট করা, যেন দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেবাসের আড়ালে ওরা আরো ভয়ংকর।
গরুর পিছে পিছে দৌড়ে আসা, আর গরুর দাম বলার দায়িত্ব এখন আর কেউ দেয় না। বাবা, মা কবরবাসী হয়ে গেলে আর যারা থাকে, ওরা পর হয়ে যায়, স্বার্থের চুল ছেঁড়া বিশ্লেষণে। কত ঈদ আসে যায়, কেউ বলার নেই, ‘কত দিন ধরে ঈদ করোস না বাড়িতে, পোলাপান লইয়া বকরা ঈদো আইয়া পড়িস।’ সেই দিন যেন বাঘে খেয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু বলেন, কোরবানির পশুর মাংস এক-তৃতীয়াংশ পরিবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-প্রতিবেশীর জন্য, এক-তৃতীয়াংশ মিসকিনদের জন্য। আরেক বর্ণনায় এসেছে, বিখ্যাত সাহাবি ইবনে মাসুদ রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু, তার কোরবানির পশুর মাংসের তিনটি ভাগ করতেন, এক ভাগ নিজেরা খেতেন, এক ভাগ যাকে ইচ্ছে তাকে খাওয়াতেন এবং এক ভাগ ফকির মিসকিনদের খাওয়াতেন। হাদিসে ভাগের কথা পাওয়া যাওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি কোরবানির সমুদয় মাংস একাকী ভক্ষণ করেন, তবুও তার কোরবানি বৈধ হবে। তবে এটা চরম বখিলতার নিদর্শন, যা নববি শিক্ষার পরিপন্থী। প্রকৃত ইমানদারের কাছ থেকে প্রকাশিত হওয়া সম্ভব নয়।
তথ্য সূত্র- গবেষনাধর্মী বই।