হাসান সিকদার ॥
এক বাড়ির আঙিনায় মসজিদ-ঈদগাঁ মাঠ ও মন্দির। ৫৪ বছর ধরে চলছে নামাজ ও পূজা। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উদাহরণ এটি। টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলা সদরের চৌধুরী বাড়ির আঙিনায় এ অসাম্প্রদায়িক পরিবেশের দেখা মিলে। প্রতিবছরের মতো এবারও চৌধুরী বাড়িতে শারদীয় দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পাশে মসজিদ আজান ও নামাজের সময় বন্ধ থাকছে ঢাক-ঢোলের বাজনা। দুই ধর্মের লোকজনরাই নিজ-নিজ ধর্মীয় আচার ও নিয়ম পালন করে আসছে। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না কারো।
জানা যায়, এই চৌধুরী বাড়িতে ৯২ বছর আগে বাংলা ১৩৩৯ সালে ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দূর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠিত করে শ্রী পরেশ চন্দ্র ও শৈলেশ চন্দ্র দাসয়ো। তারপর থেকে প্রতিবছরই ধুমধাম করে দূর্গাপূজা পালন করেন এলাকার সনাতনধর্মীর লোকজন। মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪০ বছর পর একই আঙিনায় নির্মাণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। একই স্থানে মসজিদ আর মন্দির নিয়ে কখনো কোনো দ্বন্দ্ব বা সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়নি। হিন্দু-মুসলিমরা যার যার ধর্ম পালন করে আসছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, মন্দিরে চলছে পূজা-অর্চনা, উলুধ্বনি ও ঢাকের বাজনা। পূজারি ও দর্শনার্থীরা প্রতিমা দেখতে এবং পূজায় অংশ নিতে আসছেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আজান শুরু হওয়ার আগেই ঢাকঢোল, মাইক ও বক্সের বাজনা বন্ধ করে দেয়া হয়। মসজিদ থেকে ভেসে আসে আজানের সুর। এরপর মুসুল্লিরা আসতে শুরু করেন মসজিদে। নামাজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার বেজে ওঠে মন্দিরের ঢাকঢোলের বাজনা।
পূজা দিতে আসা লিপি চক্রবর্তী বলেন, আমরা ৫৪ বছর ধেরে এখানে পূজা করতেছি। পাশে মসজিদ ও মন্দির এতে আমাদের কোন সমস্যা হয় না। মুসলিম ধর্মের মানুষ আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে। আমরাও নামাজ ও আজানের সময় পূজা বন্ধ রাখি। যুগ যুগ এই সম্প্রীতি বজায় রয়েছে। হিন্দু-মুসলিম আমরা ভাই ভাই এক সাথে মিলেমিশে থাকি। কোনো দিন দুই ধর্মের মানুষদের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি ভবিষ্যতেও আশা করি ঘটবে না। স্থানীয় বাসিন্দা ও মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান সোহেল বলেন, আমি মসজিদ ও মন্দির জন্মের পর থেকেই দেখছি। সনাতন ধর্মের লোকজন এখানে পূজা করেন। এখানে কোন ভেদাভেদ নেই। আমরা তাদের সহযোগিতা করি। আমরা সব সময় লক্ষ্য রাখি যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।
মন্দির কমিটির সভাপতি লিটন কুমার সাহা পুদ্দার বলেন, এই মন্দিরটা বহু বছরের পুরোনো। পাশেই মসজিদ ও মন্দির। হিন্দু-মুসলমান আমরা যার যার ধর্ম পালন করি। মুসলিম ভাইয়েরা আমাদের সহযোগিতা করেন। আজ পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নাই। আশা করি কখনও ঘটবেও না। আমরা যেমন মুসলমানদের ঈদে আনন্দ করি। তেমন আমাদের পূজায় মুসলমানরা আনন্দ করেন। চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা আব্দুল লতিফ মিয়া বলেন, আমি ৩৭ বছর ধরে এই মসজিদের ইমামতি করে আসছি। আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাটি নেই। আজান-নামাজের সময়সূচি তাদের কাছে দেয়া আছে। নামাজ ও আজানের সময় বাজনা বন্ধ রাখে। আমাদের নামাজে যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখে। আমরাও পূজার সময়ে তাদের সার্বিক সহযোগিতা করি। নামাজ শেষে তারা আবার তাদের ধর্মীয় উৎসব পালন করেন।
এ বিষয়ে নাগরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) দীপ ভৌমিক বলেন, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এর একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চৌধুরী বাড়ি। একই প্রান্তে মসজিদ ও মন্দির। তারা নামাজের সময় নামাজ আদায় করেছে পূজার সময় পূজা উদযাপন করছে। বিগত বছরের মতো এ বছরও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপিত হচ্ছে।
চৌধুরি বাড়ির এক আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির পরিদর্শন টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ একই আঙ্গিনায় মসজিদ-মন্দির। সারাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির উজ্জল দৃষ্টান্ত টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার চৌধুরি বাড়ির মসজিদ ও মন্দির। একই জায়গায় মসজিদ, মন্দির ও ঈদগাঁ মাঠ। এখানকার হিন্দু-মসলিমের এই মেল বন্ধন দেখে আমি অবিভূত।