স্টাফ রিপোর্টার ॥
গরিবের সস্তা ওষুধের বড় উৎস অর্জুন গাছ। রোগব্যাধিতে ভেষজ অর্জুনে উপকার পাননি এমন মানুষ গৈ-গেরামে কমই পাওয়া যায়। এর ফল-ফুল, পাতা-কান্ড, ছালবাকল, শেকড় এবং মূল কাঠ সবই কাজে আসে। তাই আদিযুগ থেকেই অর্জুন মানবসমাজের পরম বন্ধু। গ্রামীণ বসতভিটা সংলগ্ন আড়াজঙ্গল কমে যাওয়ায় অর্জুন খুব একটা চোখে পড়ে না। সরকারের চলমান সামাজিক বনায়নে বিদেশি প্রজাতির দ্রুতবর্ধনশীল বনজ বৃক্ষ অগ্রাধিকার পাওয়ায় ভেষজ অর্জনের বিস্তৃতি ঘটানোর সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দেশি বৃক্ষ অর্জুন টারমিনালিয়া জাতের সপুষ্পক উদ্ভিদ। ঋক বেদে অর্জনের উল্লেখ রয়েছে। সুলতানি ও মোগল আমলে রাজ কবিরাজেরা ভেষজ চিকিৎসায় অর্জুনের বহুবিধ ব্যবহার করতেন। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অর্জুন সংরক্ষিত হতো। অর্জুন গাছ কর্তনে কঠিন সাজা হতো।
প্রখ্যাত মোগল হাকিম নুরুলদীন সিরাজী ভেষজ চিকিৎসায় ‘আলফাজ অলাদ ওয়িয়া’ নামক যে গ্রন্থ রচনা করেন, তাতে অর্জুন গাছের উল্লেখ রয়েছে। দো-আঁশ মাটি এবং আর্দ্র ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া অর্জুনের পছন্দ। গ্রামীণ বন ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট ও শালবনে এর দেখা মেলে। ব্রিটিশ আমলে খ্রিষ্টান পাদরিদের মাধ্যমে বাংলা থেকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অর্জুন গাছ ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ওড়িষায় অর্জুনের বাণিজ্যিক আবাদ হয়। কিন্তু আদিভূমি বাংলাদেশে অর্জুন বনায়নে উৎসাহ কম।
টাঙ্গাইলের ভেষজবিদ রায়হান নদভী জানান, অর্জুন গাছের ব্যাপক বাণিজ্যিক ব্যবহার হচ্ছে ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এই গাছের কাঠ খুব শক্ত। গরু-মহিষের গাড়ির চাকা, হালের জোয়াল, নৌকার পাটাতন, দাঁড়, মাস্তুল ও গাদা বন্দুকের বাঁট বানানো হতো কাঠ দিয়ে। অর্জুন গাছের ছাল হৃদরোগের খাঁটি ভেষজ ওষুধের কাঁচামাল সংকট দেখা দিয়েছে।
মধুপুর বন গবেষণা কেন্দ্রের (চাড়ালজানি) রিসার্চ অফিসার আজিজুর রহমান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল থেকে রক্ষায় বনায়নের বিকল্প নেই। পতিত বনভূমি, সড়ক ও বাঁধ বনায়নে অর্জুনকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি ওষুধ। উচ্চ রক্তচাপ এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হ্রাস করে। মেদভুঁড়ি কমায়। কাশি উপশম করে। ডায়াবেটিসে সুগার কমায়। অর্জুন গাছের ছালের পেস্ট ও কাদ সৌন্দর্যচর্চায় ব্যবহৃত হয়। এর পাতায় ঘা, খোসপাঁচড়া ও আমাশয় দূর করে। ফুল-ফল বা বিচি থেকে নানা কবিরাজি ওষুধ তৈরি হয়। মধুপুরের পাইকারি ভেষজ ব্যবসায়ী ও শচীন্দ্র ঔষধালয়ের ম্যানেজার টোটন সাহা জানান, অর্জুন গাছ ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হারবাল ওষুধের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল। পাঁচ-ছয় বছর বয়স হলেই গাছ থেকে বছরে দুই বার ছালবাকল তোলা যায়। প্রতি বছর একটি গাছ থেকে ৩-৪ হাজার টাকার ছাল সংগ্রহ করা যায়। তবে দেশে অর্জুন গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অর্জুন গাছের ছালবাকলের দাম বাড়ছে। প্রতি কেজি অর্জুন পাইকারি ৫০-৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মধুপুর, সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকে সামান্য সরবরাহ পাওয়া যায়। কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্জুন গাছ আমদানি হচ্ছে।
বৃহত্তর ময়মনসিংহে পরিবেশ ও বৃক্ষ নিয়ে কাজ করেন হাসান মতিউর রহমান। তিনি জানান, বন বিভাগ বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ঢাকার পতিত শালবনে প্রতি বছর ৫ থেকে ৭ হাজার একরে নানা প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে বনায়ন করে। এসব বনায়নে বিদেশি প্রজাতির আকাশমণিসহ নানা বনজ চারা লাগানো হয়। বন বিভাগের চলমান সুফল প্রকল্পে বনজ ও ফলদ চারা বনায়ন হলেও অর্জুন গাছ উপেক্ষিত থাকছে। বন বিভাগের নিজস্ব নার্সারিতে এখন অর্জুনের চারা পাওয়া যায় না।
মধুপুর বন গবেষণা কেন্দ্রের (চাড়ালজানি) রিসার্চ অফিসার আজিজুর রহমান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল থেকে রক্ষায় বনায়নের বিকল্প নেই। পতিত বনভূমি, সড়ক ও বাঁধ বনায়নে অর্জুন গাছকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। অর্জুন গাছ আকারে বড় হওয়ায় বজ্রপাত নিরোধে কাজ করে। পাখপাখানি সুউচ্চ ডালপালায় বাসা বাঁধায় প্রজননে সুবিধা হয়। ঘন ও পুরু পাতার অন্তরণে মানুষ নিরবচ্ছিন্ন ছায়া পায়। এই গাছ অনেক বেশি অক্সিজেন দেয়। ফল-ফুল দিয়ে কবিরাজি ওষুধ তৈরি হয়।
উত্তর টাঙ্গাইল নার্সারি মালিক সমিতির সম্পাদক আরিফ রায়হান জানান, বন বিভাগ নব্বইয়ের দশকে টিএনডিপি এবং পরবর্তী সময়ে ফরেস্ট্রি সেক্টর প্রকল্পের মাধ্যমে কমপক্ষে ৩০ হাজার একরে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সামাজিক বনায়ন করে। এসব বনায়নে খুব নগণ্যসংখ্যক অর্জুন গাছের চারা লাগানো হয়। পরিপক হওয়ার পরপরই সেসব গাছ অপরাধীরা কেটে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে মধুপুর বনাঞ্চলের দোখলা রেঞ্জ অফিসার আব্দুল হামিদ জানান, সামনের দিনে বনায়নে অর্জুন গাছকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। চাড়ালজানি রেঞ্জ অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বনজ গাছের পাশাপাশি ভেষজ অর্জুন গাছকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এই গাছের উপকারিতা অনেক।