টাঙ্গাইলে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে সাপ্তাহিক হাট

টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল সদর টাঙ্গাইল স্পেশাল লিড নিউজ

সাদ্দাম ইমন ॥
একদা জনৈক রহিম মিয়া মেঠো পথ ধরে কয়েক ক্রোশ দূর হতে কাঁধে বা হাতে মাঝারি আকারের মদনি (বেতের তৈরি পাত্র বিশেষ) ভর্তি প্রাত্যহিক জীবনের অনেক চাহিদা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যা-সাজে বাড়ি পানে হন হন করে ছুটে চলা। কিংবা কৃষক করিম শেখ তার উৎপাদিত পণ্য বা পাটের আঁটি নিয়ে ভোরবেলা হাটের পানে ছুটে চলা, বা কালুর মা তার ছেলে কালুকে দিয়ে তার পালের মুরগি দু’খানা দিয়ে হাটে পাঠানোর যে দৃশ্য তা আজ প্রায় অন্তিমক্ষণে। যারা সেই সময়ের সঙ্গে পরিচিত তাদের মানসপটে হয়ত স্মৃতিগুলো এখনও উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলায় ছোট-বড় ২৪৩টি হাট-বাজার রয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় করটিয়া হাট, আয়নাপুর হাট, তোরাপগঞ্জ হাট, ধরেরবাড়ী হাট, গোপালপুর উপজেলার নলিন হাট, হেমনগর হাট, ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী হাট, নিকরাইল হাট, ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়া হাট, হামিদপুর হাট, কদমতলি হাট, কালিহাতী উপজেলার বল্লা হাট, পৌজান হাট, রতনগঞ্জ হাট, নারান্দিয়া হাট, মগড়া হাট, দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন হাট, নাল্লাপাড়া হাট, পুটিয়াজানি হাট, ছিলিমপুর হাট, রুপসী হাট, নাটিয়াপাড়া হাট, দেউলী হাট, নাগরপুর উপজেলার পাকুটিয়া হাট, শাহজানী হাট, গয়হাটা হাট, মির্জাপুর উপজেলার দেওহাটা হাট, হাটুভাঙ্গা হাট, বাসাইল উপজেলার ময়থা হাট, আইসরা হাট, সখীপুর উপজেলা নলুয়া হাট, হতেয়া হাট, বহেরাতৈল হাট, তক্তারচালা হাট, কুতুবপুর হাট, মধুপুর উপজেলার জলছত্র হাট, শোলাকুড়ি হাট, ধনবাড়ী উপজেলার কেন্দুয়া হাট, নরিল্লা হাট, মুশুদ্দি হাট জেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
অনলাইন কেনাকাটা আর নিত্যপণ্যের লভ্য যখন হাতের মুঠোয় তখন সাপ্তাহিক গ্রামগঞ্জের হাট একেবারেই নিঃপ্রয়োজন বলে আপনার মনে হতেই পারে। মুক্তবাজার অর্থনীতি আর ডিস্ট্রিবিউশন চেইন যখন এতো শক্তিশালী সেখানে সাপ্তাহিক হাট তো একেবারে অতীত হওয়ার জোগার। আসলেই তাই কালের বিবর্তনে সেই বাস্তবতাই আমাদের সামনে। একটা সময় ছিল যখন অর্থনীতিতে বাজার বা হাটই ছিল চলমান পণ্য বেচা বা কেনার একমাত্র মাধ্যম, মানুষের বড় বড় বাণিজ্য হতো হাটের মাধ্যমে, আমাদের সোনালি আঁশ পাট, ধান, চাল, মসলা, কাপরসহ সকল নিত্যপণ্যের একমাত্র কেনাবেচার স্থান ছিল হাট। সেই হাট এখন বিলুপ্তির পথে। তবে এর মাঝেও কিছু কিছু হাট তাদের অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে স্ব গৌরবে তার মহিমা ছরাচ্ছে। তার মধ্যে টাঙ্গাইল সদও উপজেলার ঐতিহাসিক করটিয়া হাট। লৌহজং নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা এই হাটটির ইতিহাস প্রায় ১০০ বছর।
কালের বিবর্তনে হাটটি হয়ত তার রূপ কিছুটা হারিয়েছে। তবু শহরের এতো কাছে হওয়া সত্ত্বেও স্বমহিমায় এখনও তার পসরা দিয়ে যৌবন ধরে রেখেছে। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গল ও বুধবার ফজর ওয়াক্ত শেষে হাটে পণ্য ও ক্রেতা আসতে থাকে। সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে হাটের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যেন তার উজ্জ্বলতা প্রকাশ করতে থাকে। বিশাল কাপড়ের হাট এটি। এক পাশে রয়েছে গরু ও ছাগলের বেচাকেনার স্থান। ছোট বড় অসংখ্য পশু আসে হাটে, যার মাধ্যমে সকল প্রকার ক্রেতা ও বিক্রেতা তাদের পছন্দ অনুযায়ী তাদের পশু ক্রয় ও বিক্রয় করার সুযোগ সৃষ্টি করে। অনেক কৃষক তার পশু উপযুক্ত দামে এখানে ক্রয় ও বিক্রয় করতে পারে। এছাড়াও হাটে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উঠে।

নদীর তীর ঘেঁষে বসে কাঠ, বাঁশ, চাটাই, কাঠের ও আসবাব পত্রের হাট। এখান হতে ক্রেতা সহজে তার গৃহনির্মাণ সামগ্রী ক্রয় করতে পারে। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা যুগ যুগ ধরে আশে পাশের বিভিন্ন জেলা হতে এসব বাঁশ কাঠ নিয়ে ভোরবেলা নৌকা যোগে হাটে আসে। সুলভ মূল্যের কারণে প্রচুর ক্রেতার সমাগম ঘটে সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এমন কিছু ক্রেতার সঙ্গে কথা হলো, তাদের মতে, এখানে সকাল সকাল আসতে পারলে আপনি এখান হতে আপনার পছন্দ মতো আপনার প্রয়োজন ও সাধ্যের মধ্যে ভাল মানের কাঠ, বাঁশসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী ক্রয় করতে পারবেন। বিক্রেতারাও বেশ ভাল আয় করতে পারে প্রতি হাটবার। হাটের ঠিক পশ্চিম পাশে হাঁস-মুরগি, কবুতর বেচাকেনা হয়। ক্রেতারা তার রসনা মেটাতে দেশী হাঁস-মুরগি অনায়াসে সংগ্রহ করতে পারে এ হাট হতে।
হরেক রকম সবজি থাকে হাটের একটি অংশে। বিক্রিও বেশ ভাল। পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুনসহ মসলার বাজারও এখানে ভাল। পাইকারি দামে এসব মসলা, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ইত্যাদি বিক্রি হয় বলে আশপাশের কয়েক থানার লোকজন এখানে একটু সাশ্রয় এর আশায় চলে আসেন তাদের মাসিক বাজার করার জন্য। এ হাটের মূল বেচাকেনা হয় শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও গেঞ্জি। একজন বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি হাটে তার বিক্রি প্রায় ১০ হাজার হতে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। তারা বংশানুক্রমিকভাবে এই হাট করেন। তার বাবা করত, এখন সে এবং তার ছেলে করছে।
এই হাটের রয়েছে ইজারাদার। ফলে এই হাট হতে রাজস্বও পেয়ে থাকে সরকার। সেই অনুযায়ী হাট উন্নয়নে তেমন কোন অবকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। এসব হাটে এক সঙ্গে অনেক পণ্যের সমাগম হয় যা সাধারণ বাজারগুলোতে পাওয়া যায় না। দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নে হাটগুলো হতে পারে বড় নিয়ামক। যা প্রাচীন বাংলার অর্থনীতির একটি বুনিয়াদ ছিল। সুতরাং দেশের আনাচে-কানাচে এমন হাটগুলোর সংস্কার করে বাজার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এতে গ্রামের অর্থনীতি হবে আরও সমৃদ্ধ।

 

১৫ Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *