সখীপুরে ৫২ বছরের পুরোনো কুতুবপুর কলার হাট

কৃষি টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল স্পেশাল লিড নিউজ সখিপুর

সাদ্দাম ইমন ॥
শীতের হালকা কুয়াশার চাদর জড়িয়ে রেখেছে চারপাশ। সকালের সূর্য উকিঝুকি করছে। আঁকাবাঁকা আর উঁচু-নিচু পথ গিয়ে ঠেকেছে কুতুবপুর নামের একটা বাজারে। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কুতুবপুর বাজারটি মূলত কলার হাট হিসেবে সারাদেশে পরিচিত। শীতের ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিভিন্ন প্রান্তের মাঠের কাদি কাদি কলা আসছে এই হাটে। কলা বছরব্যাপী উৎপাদিত ফল হলেও শীতে একটু কমই বিক্রি হয়। তারপরও কলার পরিমাণ এবং কলা ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা কম নয়। সরগরম এই হাটে ও বাজারে বেচাকেনায় ব্যস্ত চাষি ও ব্যবসায়ী সবাই। দীর্ঘ ৫২ বছরের পুরোনো টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার বড়চওনা ইউনিয়নের কুতুবপুর কলার হাট এখন সবার মুখে মুখে। দিন যতই যাচ্ছে ততই সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। কলার হাট হিসেবে ইতিমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা হাটটিতে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৫ কোটি টাকার কলা বিক্রি হয়ে থাকে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
তিন দশকে বদলে গেছে টাঙ্গাইলের কৃষি। একসময় এ অঞ্চলের ভূমি ছিল চাষের অনুপযোগী। উঁচু-নিচু আর সেচ-স্বল্পতায় খুব একটা ফসল ফলানো সম্ভব হতো না। আশির দশকের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলের সখীপুর, ঘাটাইল, বাসাইল, সাগরদীঘি, গারোবাজার এসব অঞ্চলের ভূমিরূপ একই রকম হওয়ায় এ অঞ্চলগুলোয় প্রথম জার্মানি সংস্থা জিটিজেড বারিড পাইপ ইরিগেশন চালু করে। ব্যয়বহুল সেচ ব্যবস্থাপনার কারণে টাঙ্গাইলের এই অঞ্চলগুলোতে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষির দেখা মিলছে। সেচের অভাবে একসময় অভাবে কাটানো স্থানীয় কৃষকেরা এখন বেশ সচ্ছল। এখানকার সমতলীয় উচ্চভূমি, অর্থাৎ ছোট ছোট টিলা ও পাহাড়বেষ্টিত লাল মাটিতে শুধু কলা নয়, আনারসসহ উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদে দারুণ উপযোগী এখন। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ফল, ফসলের দারুণ বৈচিত্র্য এসেছে এখানে। স্থানীয় কৃষকের কাছে আনারসের পাশাপাশি কলা হয়ে উঠেছে অর্থকরী ফসল। রাস্তার দুইপাশে বিস্তীর্ণ আবাদি এলাকায়ও দেখা মেলে কলাবাগানের। সাগরকলা, চিনিচম্পা, সবরি ও বাংলা কবরিসহ নানা রকম কলার আবাদ হচ্ছে। এখানকার উৎপাদিত কলা ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে কুতুবপুর কলার হাট।

 

 

দূরদূরান্ত থেকে সাইকেল অথবা ভ্যানে করে কলা বয়ে আনেন কৃষকরা। সকালের সূর্যের আলোয় সেটাও দেখার মতো দৃশ্য। সারি সারি সাইকেলে কলার ছড়ি বাঁধা। ভ্যানে বা অটোরিকশায় কলা আসছে। কলা ঘিরে সকাল সকাল অন্য রকম ব্যস্ততা সেখানে দেখা যায়। কলার বর্তমান বাজারদর, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং দরপতনের নানা কারণ জানা গেল বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাদের কাছ থেকে। কলা চাষিরা বলেন, একটি কলার ছড়ি উৎপাদন করতে সাকুল্যে খরচ ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। আর প্রতিটি কলার ছড়ি পাইকারের কাছে বিক্রি করছেন ৪০০ টাকা করে। ফলে ছড়ি প্রতি লাভ থাকছে ২০০ টাকা। এক পাকি, অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ জমিতে ৫০০টি কলাগাছ রোপণ করা যায়। হিসাব করে দেখা গেল কলা চাষ করে ৩৫ শতাংশ জমি থেকে লাখের ওপর লাভ পাচ্ছেন কৃষক। সাধারণত একেকটি ছড়িতে ২০ থেকে ২৫ হালি কলা হয়। কথা হয় এলাকার কৃষক জসিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর ২ হাজার ২০০টি কলাগাছ আছে। বাজারে এনেছেন ৫০ ছড়ি। সবরি কলার দর বেশি। ৮০০ টাকা ছড়িপ্রতি দাম বলে গেছেন পাইকার। অপেক্ষায় আছেন আরেকটু বেশি দাম পাওয়ার।
সেচের সুবিধা পেয়ে একসময় অল্পবিস্তরে কলার আবাদ শুরু হলেও কলা চাষের অন্যতম এক ক্ষেত্র এখন টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলা। বছর গেছে আর একজন কৃষকের সাফল্য দেখে অন্য কৃষক উদ্বুদ্ধ হয়েছেন নতুন করে কলা চাষে। সবখানেই কৃষকের নিজস্ব ও টেকসই কিছু পদ্ধতি থাকে ফল পাকানো ও বাজারজাত করার। এখানেও কলা পাকানোর জন্য রয়েছে কৃষকের নানা কৌশল। কিন্তু তা যেন বাণিজ্যিক চাহিদার দোহাই দিয়ে স্বাস্থ্যের জন্য অনিরাপদ না হয়ে ওঠে। বাজারে উপস্থিত কলাচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মানুষের সুস্বাস্থ্য বিবেচনায় রেখেই তাঁরা কলা পাকান। আধুনিক কৃষির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৃষি প্রযুক্তির কল্যাণে এখানেও কলা চাষে বৈচিত্র্য এসেছে। দু-একবার কলা চাষে বিপর্যয় ঘটলেও কলার আবাদ কমেনি; বরং দিনে দিনে কলার চাষ বেড়েছে। বহু শিক্ষিত তরুণ কলাচাষে যুক্ত হয়ে পেয়েছেন সাফল্য।
কুতুবপুর কলার হাটের চাষিদের কাছেই জানা গেল, কোনো কোনো চাষির কলা জমিতেই বিক্রি হয়। আবার অনেকের কলা বাগানসহ বিক্রি হয়ে যায়। তবে বেশির ভাগ কৃষক কলা সরাসরি এই হাটেই বিক্রি করে থাকেন। একেকটি কলার ছড়িতে কমপক্ষে ১০০-১২০টি কলা রয়েছে। যার স্থানীয় পাইকারি ক্রয়মূল্য ৪০০-৪৫০ টাকা; অর্থাৎ প্রতিটি কলার পাইকারি মূল্য দাঁড়াচ্ছে গড়ে সাড়ে তিন থেকে চার টাকা। অথচ একটি কলার খুচরা মূল্য কমপক্ষে ৮ বা ১০ টাকার কম নয়। কলা আবাদ করে কৃষকেরা সুখী। কলার আবাদ পাল্টে দিয়েছে টাঙ্গাইলের একসময়ের পিছিয়ে পড়া এসব অঞ্চলকে। এখানে এখন সমৃদ্ধি। সেচ-সুবিধা আর একটু দিক-নির্দেশনা তাদের এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর। কুতুবপুর কলার হাটে বসে বয়স্ক কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। তারা তাঁদের পুরোনো দিনের কথা মনে আছে বলে জানান, পানির জন্য হাহাকার ছিল এই অঞ্চলগুলোতে। টাঙ্গাইল অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বারিড পাইপের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে যেন শুধু সেচ নয়, পৌঁছে দিয়েছে সমৃদ্ধির ঠিকানা। যা এখন ভোগ করছে এলাকার কৃষক সমাজ থেকে শুরু করে সবাই। কুতুবপুর কলার হাটে উপস্থিত চাষির মতো বহু চাষি রয়েছেন টাঙ্গাইলে। যাঁরা কলার চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। আর্থসামাজিকভাবেও নিজেদের এগিয়ে নিয়েছেন বহুদূর।
এখানে কৃষক থেকে কৃষকেই ঘটেছে কলা চাষের সম্প্রসারণ। এ ক্ষেত্রে শুধু কলা নয়, যেকোনো বাণিজ্যিক কৃষির সাফল্যই নির্ভর করে কৃষক বা উদ্যোক্তার নিজস্ব উদ্যম, পরিশ্রম এবং আধুনিক কলাকৌশল ব্যবহারের ওপর। টাঙ্গাইলের কলা চাষের এই বিশাল সাফল্যের পেছনেও অনেক বড় অবদান রেখেছে একসময়ের টাঙ্গাইল অ্যাগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (টিএডিপি)। একটি বাস্তবমুখী উন্নয়নের পরিকল্পনায় যে গোটা এলাকা বদলে যেতে পারে, তারও অনন্য উদাহরণ এটি। যার ধারাবাহিকতায় এখন কলার পাশাপাশি উৎপাদন হচ্ছে অন্যান্য ফসলও। ফলে গোটা এলাকার কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন; যা ধরে রাখতে এখন দরকার কৃষকের বাজার ব্যবস্থাপনাসহ ছোটখাটো সংকটগুলো সমাধান করা। টাঙ্গাইলের পাহাড়ি মাটিতে এখন যে ধরনের উচ্চ মূল্যের ফল-ফসল উৎপাদন হচ্ছে। তা দেশের অন্য অঞ্চলগুলোর জন্য অনুকরণীয়। ফল আবাদি এলাকা হিসেবে এখানে আরও সমৃদ্ধির স্বাক্ষর রাখবেন স্থানীয় কৃষক ভাইয়েরাও।
টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কুতুবপুর বাজারে কলার হাট হিসেবে ইতিমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা হাটটিতে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৫ কোটি টাকার কলা বিক্রি হয়ে থাকে। সপ্তাহে শনি, রবি, মঙ্গল ও বুধবার এখানে কলার হাট বসে। তবে হাটবারের আগের দিনই কলা বিক্রির জন্য চাষিরা হাটে কলা এনে পসরা সাজিয়ে রাখে। এখান থেকে কলা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি টাকার কলা যায় ঢাকা নগরীসহ জেলা শহরগুলোতে। আর বাকি কলা যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয় কলা চাষী, ব্যবসায়ী ও হাট ইজারাদারদের সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

 

হাটের দিনগুলোতে দেখা যায়, কলা চাষিরা সাইকেল, ভ্যান, অটো, পিকআপে করে কলার কাঁদি নিয়ে বিক্রি করতে এসেছেন। নানা জাতের এসব কলা কিনতে দূর দূরান্তের বেপারিরা ভিড় জমিয়েছেন। চাষিদের সঙ্গে দরদাম নিয়ে কথা বলছেন। দরদামে মিলে গেলে ব্যবসায়ীরা এসব কলা বিভিন্ন পরিবহনে করে নিয়ে চলে যাচ্ছেন রাজধানী ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের নানা প্রান্তে। হাটবারের আগের দিনই কলা বিক্রির জন্য চাষীরা হাটে কলা এনে পসরা সাজিয়ে রাখে। এখান থেকে কলা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় তিন কোটি টাকার কলা যায় ঢাকা নগরীসহ জেলা শহরগুলোতে। আর বাকি কলা যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয় কলা চাষী, ব্যবসায়ী ও হাট ইজারাদারদের সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কুতুবপুর বাজারের কলা ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি হাটে এখান থেকে ভরা মৌসুমে ৪’শ থেকে ৫’শ ট্রাক কলা দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। মৌসুম ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে আড়াই’শ থেকে ৩’শ ট্রাক কলা দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় কলার হাট এখন সখীপুর উপজেলার কুতুবপুর বাজার। এই হাটে উপজেলার বড়চওনা, দারিপাকা, শ্রীপুর, তৈলধারা, বড়বাইদপাড়া, সাড়াসিয়া, কুতুবপুর, মুচারিয়া পাথার, শালগ্রামপুর, গজারিয়া, কীর্ত্তণখোলাসহ বিভিন্ন গ্রামের কলা চাষীরা কলা বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। এছাড়াও জেলার সাগরদিঘী, গারোবাজার, ঘাটাইল, মধুপুর, কালিহাতী, ধনবাড়ি উপজেলা এবং ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, ভালুকা উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে চাষি ও ব্যবসায়ীরা কলা বিক্রি করতে আনেন। এরপর তাদের কাছ থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কলা কিনে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্রগ্রাম, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে বিক্রি করেন। কুতুবপুর বাজারের কলা ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি হাটে এখান থেকে ভরা মৌসুমে ৩শ’ থেকে ৪শ’ ট্রাক কলা দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। মৌসুম ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে ২শ’ থেকে আড়াইশ’ ট্রাক কলা দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়।
টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় মৌসুমে ৪ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছে। মধুপুর, ঘাটাইল, সখীপুর, কালিহাতীসহ পাহাড়ি এলাকায় কলার আবাদ বেশি হয়। এসব এলাকাতে বিভিন্ন জাতের কলার আবাদ হয়। সাগর কলা, সরবি কলা, হিম সাগর, মিহির সাগর ও অমৃত সাগরসহ নানা জাতের কলা চাষ করেন চাষিরা। কলা চাষিরা বলেন, এ বছর দামটা ভালো পাচ্ছি। অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর প্রতি কাঁদি কলা একশো থেকে দুইশো টাকা দাম বেশি। সার ও কীটনাশকের দাম কম থাকলে চাষিরা কলা বিক্রি করে আরও লাভবান হতো। কলার বেপারিরা জানান, প্রতি কাঁদি কলা দেড়শো থেকে আটশো টাকায় বিক্রি হয়। তবে কাঁদি, স্বাদ ও মানভেদে দাম ওঠানামা করে। ছোট আকারের কলা প্রতি কাঁদি দেড়শো টাকা, মাঝারি আকারের কাঁদি তিনশ টাকা, বড় আকারের কাঁদি সাড়ে চারশো থেকে আটশো টাকায় বিক্রি হয়। এ বছর কলার দাম একশো থেকে দুইশো টাকা বেশি। প্রতি সপ্তাহে কলার হাট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কলা যাচ্ছে। বাগাড়া গ্রামের কলা চাষি শহিদুল ইসলাম জানান, হাটটিতে উপজেলার বড়চওনা, দাড়িপাকা, শ্রীপুর, তৈলধারা, মুচারিয়া পাথার, শালগ্রামপুর, ঘাটাইল উপজেলার সাগরদিঘী, জোড়দিঘী, গারোবাজার, মধুপুর উপজেলার মহিষমারা, শালিকা, আশ্রা, নেদুরবাজার এবং ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার কৈয়াদি, ফুলবাড়িয়া উপজেলার ফুলতলা, এনায়েতপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার উৎপাদিত কলা বিক্রি হয় এই হাটে। কুতুবপুর বাজারের কলা ব্যবসায়ীরা জানান, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতি শনিবার বিকাল থেকে রবিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং মঙ্গলবার বিকাল থেকে বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত কলা আমদানি হতে থাকে। কিন্তু এখন শনি, মঙ্গলবারসহ চার দিন বসে এ হাট। কলাচাষী ও ছোট ব্যবসায়ীরা এ হাটে কলা আমদানি করে থাকেন।

 

 

কুতুবপুর হাটে গিয়ে আরও দেখা যায়, সারাদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীরা কলার দামদর করে কিনে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। কুমিল্লা থেকে আসা কলা ব্যবসায়ী ওসমান আলী জানান, এ বছর কলার দাম অনেকটা বেশি। প্রতি কঁাঁদি কলা আকারভেদে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। এ হাটের অবস্থান মধুপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কে হওয়ায়, যোগাযোগে সুবিধা পাওয়া যায়। এ হাট দিন দিন ব্যবসায়ীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ব্যবসায়ী ও কলা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর কলার দাম মোটামুটি ভালো। প্রতি কাঁদি সাগর কলা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে। এর চেয়ে ভালোমানের কলার কাঁদি বিক্রি হয় ৫০০ টাকা পর্যন্ত। সবরি কলা প্রতি কাঁদি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। এই হাটে রঙ্গিন সাগর, অমৃত সাগর, সবরি, কবরী, অগ্নিশ্বর, চিনি চাম্পাসহ আনাজী কলাও বিক্রি হয়। কলার কাঁদির ওপর নির্ভর করে দাম কমবেশি হয়ে থাকে বলে জানান ভালুকা থেকে আসা কলা চাষী আলাল মিয়া। তিনি আরও জানান, এ বাজারের কলাগুলো খুবই উন্নতমানের এবং এখানকার কলার চাহিদা দেশের সর্বত্রই রয়েছে। এ কারণে এখানে কলার দামও একটু বেশি পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, প্রতি কাঁদি কলা ১৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে কাঁদি, স্বাদ ও মানভেদে দাম ওঠানামা করে। ছোট আকারের কলা প্রতি কাঁদি ১৫০ টাকা, মাঝারি আকারের কাঁদি ৩০০ টাকা, বড় আকারের কাঁদি সাড়ে ৪০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। সখীপুর উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের কলাচাষী আবদুর রহমান জানান, টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় কলার হাট। অন্যান্য বাজারেই তুলনায় এ বাজারে বেশি কলা বিক্রি হয়। এখানে দামও কিছুটা ভালো পাওয়া যায়। এ কারণে কুতুবপুরে কলার আমদানিও বেশি হয়। কলার হাটের রাজধানী হিসেবে খ্যাত কুতুবপুর ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে ব্যাপকহারে কলার আবাদ করছেন চাষীরা। কলা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এখানে অনেকগুলো আড়ৎ গড়ে উঠেছে। সাগরদিঘী গ্রামের কলাচাষী হানিফ আলী বলেন, এ অঞ্চলের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় কলার হাট। অন্যান্য বাজারেই তুলনায় এ বাজারে বেশি কলা বিক্রি হয়। এখানে দামও কিছুটা ভালো পাওয়া যায়। এ কারণে কুতুবপুরে কলার আমদানিও বেশি।
কলাচাষী জহিরুল ইসলাম জানান, এ বছর তিনি সাড়ে চার বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে ৩শ’টি হিসাবে সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে এক হাজার ৫শ’টি কলা গাছ লাগিয়েছেন। প্রতি বিঘা জমি থেকে অন্তত ৮০ হাজার টাকার কলা বিক্রি হবে। প্রতি বিঘা জমিতে কলা চাষ করতে আমার ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। হাটকেন্দ্রিক শ্রমিক আব্দুস সামাদ জানান, এই হাটকে কেন্দ্র করে প্রায় ১০০ জন শ্রমিক কাজ করে। এতে জনপ্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে পাওয়া যায়। এই হাটের কারণেই যে পারিশ্রমিক পাই তা দিয়েই আমাদের পরিবার চলে। জানা গেছে, জেলার লালমাটি অধ্যুষিত উপজেলা মধুপর, ঘাটাইল ও সখীপুরের পাহাড়ি মাটি কলা চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় কলা চাষের প্রতি স্থানীয় কৃষকদের মাঝে আগ্রহ বাড়ছে। ইতোমধ্যে অনেক কৃষক কলা চাষে অর্থনৈতিকভাবে সফলও হয়েছেন। বেশ কিছুদিন পানামা পোকার আক্রমণে কলা চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বর্তমানে পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমে গেছে। ধান, পাটসহ প্রচলিত অন্যান্য ফসলের তুলনায় কলা চাষে শ্রম খুবই কম ব্যয় করতে হয়। বিক্রির ক্ষেত্রেও ঝামেলা নেই। কলার বাজার দরে সহজে ধস নামেনা। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকা অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় সারা বছরেই কলার চাষ করা যায়।
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ অঞ্চলে বারিকলা-১ ও বারিকলা-২ (আনাজিকলা), অমৃতসাগর, মন্দিরা, মন্দিরা সাগর, সবরি, চম্পা, চিনিচাম্পা, কবরি, মেহেরসাগর, বীচিকলা ইত্যাদি জাতের কলা চাষ হয়ে থাকে। প্রতি বিঘা জমিতে ৩৫০ থেকে ৩৮০টি কলাগাছ রোপণ করা হয়। একটি কলা গাছে রোপণ থেকে বাজার জাত পর্যন্ত ১৫০ থেকে ২০০ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি কলার ছড়ি ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি করা যায়। এ হিসেবে প্রতি বিঘায় প্রায় ৬০ হাজার টাকা কৃষকরা লাভের মুখ দেখেন। সূত্র জানায়, কলায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ভিটামিন সি রয়েছে। পাকা কলা মানব দেহে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং কলার থোড় বা মোচা ডায়াবেটিস, আমাশয়, আলসার নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
কুতুবপুর হাটের কলার আড়তদার ফজলুল হক জানান, কলা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এখানে অনেকগুলো আড়ৎ গড়ে উঠেছে। কলার কাঁদির ওপর নির্ভর করে দাম কমবেশি হয়ে থাকে বলে জানান কলা ব্যবসায়ী আলম মিয়া। তিনি জানান, এ বাজারের কলাগুলো খুবই উন্নত মানের এবং এখানকার কলার চাহিদা দেশের সর্বত্রই রয়েছে। এ কারণে এখানে কলার দামও একটু বেশি। সখীপুর উপজেলার ইছাদিঘী গ্রামের কলাচাষী আমিনুল ইসলাম জানান, এ বছর তিনি ২ একর জমিতে কলা চাষ করেছেন। কলা গাছ লাগিয়েছেন ২ হাজার। খরচ শেষে তার ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লাভ হবে বলে আশা করছেন। হাট ইজারাদার হারুন মিয়া জানান, দূরদূরান্ত থেকে আসা বেপারীরা এখান থেকে কলা কিনে নিচ্ছেন। হাটের খাজনা তুলনামূলকভাবে কমই নেওয়া হয়।

 

 

কুতুপুর বাজারের ইজারাদার হাবিবুর রহমান বলেন, দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এসে কলা কিনে থাকেন। কুতুবপুর বাজারের কলার হাটের সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা কলা কিনতে এই হাটে আসেন। এই হাটে টোল অন্য সব হাটের চেয়ে কম। আগে এই হাট দুই দিন হতো এখন সপ্তাহ চার হাট বসে। শনিবার, রোববার ও মঙ্গলবার, বুধবারের হাটে প্রায় কোটি টাকার কলা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। মূলত কলাচাষি ও ছোট ব্যবসায়ীরা এ হাটে কলা আমদানি করে থাকেন। এরপর তাদের কাছ থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সেগুলো কিনে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্রগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে বিক্রি করেন। কুতুবপুর বাজার কমিটির সহ সম্পাদক আব্দুল কাদের বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বেপারিরা কলা কিনতে আসেন। এই বাজারে থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা নাই। ঢাকাসহ আশেপাশের সকল জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় দিন দিন এ হাট জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই হাট আগে দুই দিন হলেও এখন চারদিন বসে। কুতুবপুর কলার হাটের উপদেষ্টামন্ডলীর অন্যতম সদস্য ও স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, সপ্তাহে চারদিন কলার হাটটি বসে। তবে হাটের আগের দিনই চাষিরা কলা এনে বিক্রির জন্য থরে থরে পসরা সাজিয়ে রাখে। হাটবারের দিন ভোর থেকেই বেপারীরা কলা কিনতে শুরু করেন।
ঐতিহ্যবাহী কুতুবপুর কলার হাটের বিষয়ে সখীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিয়ন্তা বর্মন বলেন, এ হাটের উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সখীপুরসহ এ অঞ্চলের মাটি কলা চাষে বেশ উপযোগী। ৩০ বছর আগে এ উপজেলায় প্রচুর কলার চাষ হতো। ১০ বছর আগে কলা চাষ কমে যায়। ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় এখন আবার কলা চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এ বছর উপজেলায় ৪৫০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছে। প্রায় দুই হাজার মানুষ কলা চাষের সঙ্গে যুক্ত।

 

 

Views

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *