
আদালত সংবাদদাতা ॥
গত (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর অন্য সমন্বয়কদের থেকে আলাদা হয়ে যান মারইয়াম মুকাদ্দাস (মিষ্টি)। তার কিছু অনুসারি নিয়ে চলাচল শুরু করে। তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ অফিসসহ নেতাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টির এসব কর্মকান্ডের দায় নিচ্ছেন না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকরা।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলামের বাড়ি দখল করে “পাগলের আশ্রম” চালু করার ঘটনায় মারইয়াম গ্রেপ্তার হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার অন্যান্য নেতারাও তার বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মারইয়াম মুকাদ্দাস (মিষ্টি) বাসাইল উপজেলার যশিহাটী গ্রামের মাজহারুল ইসলামের মেয়ে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক নেতা জানান, গত জুলাই মাসে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি তাতে যোগ দেন। তবে শুরু থেকেই তার আচরণ ছিল রহস্যজনক। সবসময় হিজাব পড়ে থাকা মারইয়াম নিজেকে কখনও মাদ্রাসার, কখনও সরকারি এমএম আলী কলেজের, আবার কখনও ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিতেন। তিনি এসব অভিযানে ব্যাপক উগ্যভাবেই সবকিছুর নেতৃত্ব দেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর উগ্র বক্তৃতা দিয়ে সবার নজরে আসেন। কথায় কথায় আইন নিজ হাতে তুলে নেয়ার হুমকি দিতেন। এ নিয়ে আন্দোলনে সমন্বয়কদের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তবে সমন্বয়ক পরিচয়ে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন সভায় তাকে অংশ নিতে দেখা গেছে। মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টির কয়েকজন অনুসারি নিয়ে ছিন্নমূল মানুষদের জন্য একটি আশ্রম গড়ে তোলেন। গত (৬ ফেব্রুয়ারি) মিষ্টি তার কিছু অনুসারি নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় স্কেভেটর দিয়ে গুড়িয়ে দেন। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য প্রয়াত সভাপতি ফজলুর রহমান খানের, সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলামের এবং সাবেক পৌর মেয়র জামিলুর রহমানের বাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় ওই বাড়িগুলোর সব মালামাল লুটপাট হয়। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নেতাদের বাড়িঘর ভাঙচুর করারও ঘোষনা দেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর দখল করে বৃদ্ধাশ্রম, পাগলের আশ্রম, এতিমখানা করা হবে বলে মিষ্টি জানিয়েছিলেন।
ঘটনার দুইদিন আগে মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলামের বাসা “পাগলের আশ্রম”, প্রয়াত সভাপতি ফজলুর রহমান খানের বাসা “প্রতিবন্ধিদের আশ্রম”, সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনিরের বাসা “অ্যানিমেল শেল্টার”, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান সোহেলের বাসা “বৃদ্ধ আশ্রম”, সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের বাসা “এতিমখানা” এবং আওয়ামী লীগ অফিস “পাবলিক টয়লেট” করা হবে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন ‘আরও নাম সাজেস্ট করুন, তথ্য দিন। এক এক করে সামাজের ও টাঙ্গাইলের উন্নয়নের কাজে লাগুক আওয়ামী লীগের অবৈধ সম্পদ।’
তার ধারাবাহিকতায় গত শনিবার (৮ মার্চ) শহরের আকুরটাকুর পাড়ায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলামের বাড়ির তালা ভেঙে মারইয়াম প্রবেশ করেন। সেখানে ১৮ জন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী-পুরুষ উঠিয়ে দেন। ওই বাড়িটিতে “পাগলের আশ্রম” চালুর ঘোষনা দেন। পরে রাতে একজন নির্বাহী ম্যাসিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই বাড়ি খালি করে। পরে মিষ্টি প্রশাসনের কাছে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।
মিষ্টি অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িও দখলের ঘোষনা দিয়েছিলেন। জোয়াহেরুল ইসলামের স্ত্রী রোববার (৯ মার্চ) রাতে বাদি হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ওই রাতেই তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাকে ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
বাড়ি ভাঙচুর করা, আগুন দেয়া ও বাড়ি দখলের হুমকিতে থাকা একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার স্বজনদের সাথে এই প্রতিবেদকের মঙ্গলবার (১১ মার্চ) কথা হয়। তারা জানান, বাড়ি ভাঙচুরের বিষয়ে তারাও মামলা দায়েরের চিন্তাভাবনা করছেন। কিন্তু তাদের পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যরা সরকার পতনের পর থেকেই পলাতক রয়েছে। তাই মামলা করতে বিলম্ব হচ্ছে। তারা অভিযোগ করেন, মিষ্টি (৬ ফেব্রুয়ারি) কয়েক ঘন্টা ধরে নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর করে। লুটপাট হয়, কিন্তু প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এজন্যই তিনি পরে বাড়ি দখল করারও সাহস দেখিয়েছেন। বিলম্বে হলেও তাকে গ্রেপ্তার করায় স্বস্তি এসেছে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানবীর আহম্মদ জানান, কী উদ্দেশ্যে ভাঙচুর ও দখল করা হয়েছে রিমান্ডে সে বিষয়ে মিষ্টির কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর পেছনে কারও ইন্দন ছিলো কিনা তাও দেখা হচ্ছে।
তবে মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি বাড়িঘর ভাঙচুর, আগুন দেয়া, লুটপাট ও দখল এসব কর্মকান্ডের দায় নেয়নি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টাঙ্গাইল শাখার সদস্য সচিব আবু আহমেদ শেরশাহ বলেন, ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয়ে কেউ কোন অপরাধের সাথে যুক্ত হয়, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব করে এর দায় আমরা নেব না। এই দায়ভার তার নিজের। তিনি জানানা, অনেকেই জুলাই আগস্টের আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টিও ছিলেন। টাঙ্গাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি হয়েছে। মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি সেই কমিটির কেউ নন।