
সাদ্দাম ইমন ॥
দেশের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া জমিদার বাড়ি, মধুপুর বনাঞ্চল, ধনবাড়ীর নবাব প্যালেস বা নবাব মঞ্জিল অন্যতম পিকনিক স্পট হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি বিপুল সংখ্যক পর্যটকের পা পড়ে এসব স্থানে। বিশেষ করে শীত মৌসুমের পুরোটা জুড়েই ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণা থাকে দর্শনীয় এই স্থানগুলোতে। জনপদের এ ভূ-ভাগে দেখা যায়, বৈচিত্র্যের ঐক্যতান। শত শত পর্যটকের সরব উপস্থিতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায় আগতরা। তারা আসে, দেখে, জানে এবং একরাশ প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। প্রতিবারের মতো এবার শীতেও টাঙ্গাইলের এসব স্থানগুলো ভরে উঠবে ভ্রমনপিপাসুদের।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের নিয়ন্ত্রণাধীন শৌখিন পশ্চিমা ও প্রাচ্যের শৈল্পিক কারুকার্যে ভরপুর বিশাল মহেড়া জমিদারবাড়ি। দর্শনার্থীরা মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া নামক স্থানে এই বিনোদন কেন্দ্রটিতে এসে উপভোগ করা ছাড়াও জানতে পারবেন মহেড়া জমিদারদের কোন সময় কিভাবে এখানে গোড়াপত্তন ঘটে এবং তাদের ইতিহাস। স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে নান্দনিক শৈল্পিক কারুকার্য খচিত চার তরফের জমিদারদের চারটি ভবন। এর সঙ্গে রয়েছে স্ব স্ব কাচারীবাড়ি। বড় তরফের পিছনে ছিল বিশাল দুর্গামন্দির। বর্তমানে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে সুইমিংপুল। তৃতীয় তরফের পিছনে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বড় একটি বৈঠকখানা। পুরো জমিদার বাড়িটি ঘিরেই রয়েছে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং দেশী-বিদেশী ফুলের বাগান। শিশুদের আকৃষ্ট করতে রয়েছে নানা ধরনের কৃত্রিম পশু-পাখির প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য। এছাড়াও রয়েছে শিশুদের বিনোদনের জন্য শিশুপার্ক। প্রত্যেক তরফের সামনে রয়েছে প্রশস্থ রাস্তা ও ফুলের বাগান। বাড়ির প্রবেশ পথে রয়েছে দুটি সিংহদ্বার। সর্ব সামনে দক্ষিণে রয়েছে বিশাখা সাগর নামে বিশাল একটি দীঘি। জমিদারবাড়ির পিছনের দিকে রয়েছে আরও একটি দৃষ্টিনন্দন পুকুর এবং পিকনিকের ব্যবস্থা।
মহেড়া জমিদার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে এসেছেন জমিদার বাড়ি দেখতে এবং জানতে। পাঁচ বছরের উপরে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। জমিদারবাড়ির ইতিহাস কারুকাজ সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে দর্শনার্থীরা উৎফুল্ল এবং মুগ্ধ। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের মহেড়া নামক স্থানে প্রায় ১২শ’ শতাংশ জমির ওপর চার তরফের চার জমিদার চারটি ভবন নির্মাণ করে তাদের জমিদারী কার্যক্রম শুরু করেন। জমিদার বিদু সাহা, বুদ্দু সাহা, হরেন্দ্র সাহা ও কালীচরণ সাহা জমিদারের অংশীদারী ছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে মহেড়ার জমিদাররা ছিলেন কলকাতার ডালের ব্যবসায়ী।
বর্তমানে এই মহেড়া বিনোদন কেন্দ্রটিতে রয়েছে পিকনিক বা বনভোজনের ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জানা গেছে, কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বেশি লোক নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করতে চাইলে কর্তৃপক্ষকে আগে অবহিত করতে হবে। সারাদিনের জন্য চেয়ার, টেবিলসহ পিকনিকের শেড ভাড়া ১০ হাজার টাকা। এছাড়া ট্রি হাউস নামে আরও একটি শেড রয়েছে যার ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। এখানে অনুষ্ঠানসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা যায়। খাবার নিজেরা বাইরে থেকে ব্যবস্থা করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া জমিদার বাড়ির বাইরে কাউন্টার সংলগ্ন পিটিসি কো-অপারেটিভ সোসাইটি (বিকিকিনি) নামে রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
মধুপুর শালবন- হাজার বছরের প্রাচীন টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবন। ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলের পর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন মধুপুর শালবন। এ বনকে দেশের মধ্যাঞ্চলীয় বনভূমি হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এ বনের বিস্তৃতি গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার অংশজুড়ে। একসময় রাজধানী ঢাকার কাঁটাবন পর্যন্ত এ বনের সীমানা থাকলেও আজ তা শুধুই অতীত, বইয়ের পাতায় লেখা ইতিহাস। টাঙ্গাইল ও মোমেনশাহী জেলার অংশটুকু মধুপুর গড় বা শালবন নামে পরিচিত। শালগাছের মোলা বা শিকড় থেকে গজানো চারায় গাছ হয় বলে স্থানীয়রা একে গজারি বনও বলে থাকে। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে ভরপুর স্থানগুলোর মধ্যে মধুপুর গড় অন্যতম। এ বনের প্রধান আকর্ষণ গজারি গাছের সমারোহ, যে কারণে এটি শালবন নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, কয়েকশ’ বছরের পুরোনো বন এটি। যা বন বিভাগের অধীনে আসে ১৯৬২ সালে। বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৪ সালের বন্য প্রাণী আইনের আওতায় মধুপুর বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় ১৯৮২ সালে। এর আয়তন ৮৪৩৬৬ হেক্টর প্রায়। মধুপুর জাতীয় উদ্যানের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বংশী নদী। এ উদ্যানের ভেতরে ও আশপাশের প্রায় ১৮৭টি গ্রামে বসবাস করে গারো, কোচ, বামনসহ নানা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।
মধুপুর জাতীয় উদ্যানে আছে ১১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, সাত প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৮ প্রজাতির পাখি ও কয়েক প্রজাতির উভচর প্রাণীর বসবাস। এ বনের বাসিন্দা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুখপোড়া হনুমান, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, লালমুখ বানর, বন্য শূকর ইত্যাদি। বনে দেখতে পাওয়া পাখিদের মধ্যে স্ট্রুর্ক বিলড কিংফিশার বা মেঘ হু, মাছরাঙা, খয়রা গেছো পেচা, কাঠময়ূর, বনমোরগ, মুরগি। এ বনের মধ্যে লহরিয়া বন বিট কার্যালয়ের কাছে হরিণ প্রজনন কেন্দ্রে আছে বেশ কিছু হরিণ। পাশেই সুউচ্চ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে, যার চূড়ায় উঠে উপভোগ করতে পারা যায় বহুদূর পর্যন্ত বনের সৌন্দর্য। এ জায়গাতেই সবচেয়ে বেশি হনুমানের দেখা মেলে। নানা গাছপালায় সমৃদ্ধ জাতীয় এ উদ্যান। এসবের মধ্যে শাল, বহেড়া, আমলকী, হলুদ, আমড়া, জিগা, ভাদি, অশ্বত্থ, বট, সর্পগন্ধা, শতমূলী, জায়না, বিধা, হাড়গোজা, বেহুলা ইত্যাদি। এছাড়া নানা প্রজাতির লতাগুল্ম আছে এ বনে।
এই মধুপুর বনে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে রসুলপুর জাতীয় উদ্যান, দোখলা রেষ্ট হাউজ, পীরগাছা রাবার বাগান ও কাকরাইদ বীজ উৎপাদন খামার। মধুপুর উপজেলা সদর থেকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে রসুলপুর মাজার এলাকায় মহাসড়কের বাঁ পাশে মধুপুর জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের প্রধান ফটক। সেখানে নিজস্ব গাড়িতে কিংবা সিএনজি, ইজিবাইক বা ভাড়া করা গাড়িতে যাওয়া যায়। মধুপুর জাতীয় উদ্যান রেঞ্জ কার্যালয়ের অনুমতি নিয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ভেতরেই দোখলা পিকনিক স্পট, রয়েছে জলই ও মহুয়া নামের দুটি বিশ্রামাগার। চলতি পথে চোখে পড়বে বনের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য, কিংবা দেখা হয়ে যেতে পারে কোনো বন্য প্রাণীর সঙ্গে। তখন নিজেকে পুলকিত না হয়ে পারা যায় না। সেখান থেকে একটু দূরেই দোখালা রেস্ট হাউজ। এখানে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বসে তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান। এখানে রয়েছে চুনিয়া আর বকুল নামে দুটি মনোরম কটেজ। জঙ্গলে রাত্রিযাপনের এক সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নেয়া যায়। রেস্টহাউসের পূর্বপাশ জুড়ে তেঁতুল আর আমলকীর বন। দক্ষিনের সড়ক নিয়ে যাবে রাবার বাগান অবধি। পিকনিক স্পটের খোলা চত্বরে অবস্থিত সাইডভিউ টাওয়ারে উঠে লুফে নিতে পারা যায় বনের বিশাল অঞ্চলের সৌন্দর্য। পাশেই রয়েছে বনের জুঁই ও চামেলি নামক পিকনিক স্পটে।
মধুপুর বনের দ্বিতীয় প্রবেশপথ পঁচিশমাইল; রসুলপুর এলাকাগুলো হচ্ছে গারো পল্লী। সেখানেই পীরগাছা ক্রাইস্ট মিশন ও গির্জা, গারো কালচারাল সেন্টার ও আদিবাসী পোশাক বিক্রয় কেন্দ্র। মিশন থেকে আরো পাঁচ কিলোমিটার পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরুলে শোলাকুড়ি গ্রামের সুলতানি আমলের সামন্ত রাজা ভগবৎ দত্তের বিশাল দীঘি রয়েছে। দেড় হাজার একরের বিশাল দীঘির পাড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন মন্দির, যেখানে বৈশাখের পূর্ণিমায় বসে শিব পূজা ও রাসমেলা হয়। এখানে আছে সাত হাজার একরের সরকারি রাবার বাগান। খুব ভোর থেকেই শ্রমিকরা গাছের বাকল কেটে সংগ্রহ করে কাঁচা রাবার। সন্তোষপুর রাবার বাগানে যেতে চোখে পড়বে বিএডিসির সুদৃশ্য কাকরাইদ ক্যাম্পাস। ১০০ গজ সামনেই জয়তেঁতুল গ্রামের পাহাড়ি ঝরনা। কয়েক কিলোমিটার সামনেই ইতিহাস প্রসিদ্ধ সাগরদীঘি ও শতাব্দী প্রাচীন হিজলতলা মন্দির।
রাজধানী থেকে মাত্র ১২৫ কিলোমিটার উত্তরেই মধুপুরের গড়, যা চোখে পড়বে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ রোডে মধুপুর পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই। ঢাকা থেকে মধুপুর যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম সড়কপথ। পর্যটকদের নিরাপদে থাকার জন্য এখানে রয়েছে আরামদায়ক ব্যবস্থা। বনে অবস্থিত জলই, মহুয়া, জুঁই ও চামেলি কটেজে পিক সিজনে ৬০০, অব সিজনে ৩০০ টাকায় থাকতে পারবেন। জঙ্গলে রাত যাপন করতে চাইলে টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন অফিসে বুকিং দিতে পারেন আগেই, সেখানে রয়েছে ভিআইপি দোখলা বাংলো। এবারের শীতকে আনন্দময় এবং স্মরণীয় করতে পরিবার-পরিজনসহ ঘুরে আসার মতো স্থান সবুজ মধুপুর গড়ে, মিশে যান প্রকৃতির রাজ্যে।