
সাদ্দাম ইমন ॥
বিকেল সাড়ে ৫টা। টাঙ্গাইল শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে ইফতারির থালা সাজানো হচ্ছে। দু’একজন করে মানুষ আসছেন সেখানে। থালা সামনে দিয়ে তাদের বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। আগতদের মধ্যে গরীব-অসহায় ছিন্নমূল, পথচারী, রিক্সাচালক, শিক্ষার্থী, আশেপাশের দোকানী, হকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ রয়েছেন। সন্ধ্যা ৬টা বাজতেই পুরো শহিদ মিনার এলাকা ভরে যায়। কিছুক্ষণ পর সাইরেন বেজে উঠে। নানান শ্রেণীর মানুষ একসাথে ইফতার শুরু করে।
টাঙ্গাইলে বিনামূল্যে মাসব্যাপী সবার জন্য ইফতার কার্যক্রমের এই উদ্যোগ নিয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ত্রিবেণী টাঙ্গাইল’। প্রতিদিন এই ইফতারে চার শতাধিক মানুষ অংশ নিচ্ছেন। ত্রিবেণী টাঙ্গাইলের এই কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি ব্যাচ ১৯৯২।
সরেজমিন গত বুধ ও বৃহস্পতিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিকাল ৪টা থেকে প্রায় ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবী ইফতারের প্লেট প্রস্তুত করছেন। কেউ কেউ সারিবদ্ধভাবে প্লেটে ইফতার তৈরির পাশাপাশি প্যাকেট করছেন। বিকাল সোয়া ৫টার দিকে ট্রাফিক পুলিশের জন্য ৩০টি ও টহল পুলিশের জন্য ৩৫টি প্যাকেট সেখান থেকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। সাড়ে ৫টা থেকে বিভিন্ন শ্রেণির রোজাদাররা আসতে শুরু করেন। এরপর তারা সারিবদ্ধভাবে নিজ দায়িত্বে পাটের তৈরি চটে বসে পড়েন।
এরপর ডিম, খেঁজুর, মুড়ি, ছোলা, শরবত, বেগুনি, পিয়াজু, জিলাপিসহ প্রায় ৮ থেকে ১০ রকমের ইফতার সামগ্রী দিয়ে সাজানো প্লেট দেয়া হয় তাদের সামনে। ইফতার শুরুর কিছুক্ষণ আগে সেখানে একজন হাফেজ দিয়ে দোয়া পরিচালনা করা হয়। দোয়া শেষে মাইকে সাইরেন বাজতেই সবাই একত্রে ইফতার করেন। সামর্থ্যহীন অসহায় মানুষ এখানে প্রতিদিন ইফতার করতে পেরে খুব খুশি।
মিনা বেগম নামের এক বৃদ্ধা নারী বলেন, ‘আমি অসহায় মানুষ। রোজা শুরুর দিন থেকেই এখানে প্রত্যেকদিন ইফতার করতাছি। বাড়িতে ভালো কিছু দিয়া খেয়ে ইফতার করতে পারি না। এই জাগার ইফতারের আয়োজন আমাগো মতো গরীব মানুষের জন্য অনেক উপকারে আসছে।’
জোমেলা বেগম নামের আরেক নারী জানান, তিনি পাশেই ফুটপাতে ছোট্ট একটি দোকান করেন। কয়েক বছর যাবত রোজার মাসে শহিদ মিনার চত্তরে প্রতিদিন ইফতার করেন। তার মতো এমন অনেক দরিদ্র মানুষ সহজেই এখানে ইফতার করতে পারেন বলে জানান।
শহরে কেনাকাটা করতে আসা অনেক পথচারীরাও এখানে ইফতার করছেন। তারা জানিয়েছেন, হাতে সময় কম থাকায় এবং রাস্তায় পাশেই এমন আয়োজন দেখে এখানে তারা ইফতার করতে এসেছে।
বুধবার শহরে একটি কাজে এসেছিলেন কালিহাতীর ঘোনাপাড়া এলাকার আব্দুর রহমান। কাজ শেষে রওনা হওয়ার আগে ইফতারের সময় হয়ে যায়। নিরালা মোড় এলাকার রেঁস্তোরাগুলোতে আসন ফাঁকা পায়নি। আশেপাশে খোঁজ করতে থাকেন কোথায় ইফতার করবেন। এ সময় শহিদ মিনারে ইফতারির আয়োজন দেখতে পান। গেটের কাছে যেতেই স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে নিয়ে ইফতারির প্লেটের সামনে বসিয়ে দেন। ইফতার শেষে তিনি বলেন, যারা এমন মহতী কাজের উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
ত্রিবেণী টাঙ্গাইলের সদস্য বিভূতি কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘ত্রিবেণী টাঙ্গাইল ও বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি ১৯৯২ ব্যাচ সম্মিলিতভাবে ইফতার কার্যক্রমটি পরিচালনা করে আসছে। আমাদের এখানে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ লোকজন ইফতার করেন। পথচারী, গাড়িচালক, ভিক্ষুক, দোকানদারসহ প্রায় সব পেশার মানুষ আসেন। খুবই আনন্দের সঙ্গে তারা ইফতার করেন। আমাদের ইচ্ছে আছে, এই কার্যক্রমটি আগামীতেও অব্যাহত রাখার।’
ত্রিবেণী টাঙ্গাইলের সভাপতি বাপ্পি খান বলেন, ‘আমাদের ইফতার কার্যক্রমটি ২০১৪ সাল থেকে চলে আসছে। মাসব্যাপী বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য বিনামূল্যে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। অসহায়, গরিব ও গাড়িচালক ছাড়াও শহরে কেনাকাটা করতে আসা মানুুষও ইফতার করতে আসেন। ডিম, কলা, ছোলা, মুুড়ি, পেঁয়াজু, শরবত, জিলাপিসহ প্রায় ১০টি আইটেম দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে খিচুড়ি মাংসও দেওয়া হয়। ট্রাফিক পুলিশ ও টহল পুলিশের ৬৫ জন সদস্যের ইফতার আমরা প্যাকেট করে দিই। সবমিলিয়ে প্রতিদিন চার শতাধিক মানুষের জন্য এখানে ইফতারের আয়োজন করছি আমরা।’
ত্রিবেণী টাঙ্গাইল একটি সামাজিক সংগঠন, এর সদস্য ৬০ জন উল্লেখ করে বাপ্পি খান আরও বলেন, ‘এ ছাড়া বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি ১৯৯২ ব্যাচের ৬০ জন রয়েছেন। ১২০ জন মিলে ইফতার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। আমরা ১২০ জনে মিলে কার্যক্রমের অর্থ ব্যয় করি। এটি সবার জন্য একটি বার্তা। আমাদের মতো অন্যান্য জেলায় বিনামূল্যে ইফতার বিতরণের কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন।’